Monday, May 20, 2024
Homeআয়ুর্বেদবাত পিত্ত ও কফ এই ত্রিদোষ জাত অর্থ কি?

বাত পিত্ত ও কফ এই ত্রিদোষ জাত অর্থ কি?

বাত পিত্ত ও কফ এই ত্রিদোষ জাত অর্থ কি?

বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক পুস্তকের কিছু কিছু স্থানে ঔষধ বিবরণ প্রদান এর সাথে সাথে বাত, পিত্ত ও কফ এই তিনটি ধাতু সম্বন্ধে বলা আছে। আমাদের অনেকেরই হয়তো এই বিষয়গুলো বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।
প্রথমদিকে আমারও বুঝতে অসুবিধা হত। কেননা এই তিনটি বিষয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।

যদিও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট নয় বলে মনে হতে পারে কেননা অর্গাননে এভাবে কোথাও বলা হয়নি। তবে অর্গাননে মায়াজম বর্ণনার ভেতরে এই অংশটির সাদৃশ্য আছে অর্থাৎ মায়াজমের ভেতরেই সামগ্রিক ধাতুগত বিবেচনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ অর্গাননে হয়তো ধাতুগত বিষয় বোঝাতে এই তিনটি ‘শব্দ’ (বাত, পিত্ত, কফ) ব্যবহৃত হয়নি তবে ভিন্নভাবে এগুলি বর্ণিত আছে।

এই তিনটি ধাতু সম্বন্ধে জানা থাকলে শারীরিক গঠন বিবেচনা ও অসুস্থতার ধরণ বিবেচনায়, general constitution এর সাদৃশ্যে রোগীর জন্য সর্বাধিক সাদৃশ্যযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করা সহজ হয়।

৬০০০ বছর পূর্বে ব্রম্মার থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান দ্বারা, ধন্বন্তরি(দিবোদাস) এর দ্বারা প্রবর্তিত চিকিৎসা বিষয়ক অংশ(উপবেদ) যেটিকে আয়ুর্বেদ বলে যা ‘অথর্ববেদ’ এর অভ্যন্তরে ১১৪ টি স্তোত্র দ্বারা বর্ণিত সেখানেই এই তিনটি বিষয়ে সর্বপ্রথম আলোকপাত করা হয়।

আমি এখানে এই তিনটি ধাতু বাত, পিত্ত ও কফ এর বিষয়ে যথাসম্ভব আলোচনা করার চেষ্টা করছিঃ

————-

আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের শরীরে তিনটি দোষ বিদ্যমান থাকে। এই তিনটি দোষ যখন দূষিত হয়ে এদের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন শরীর নানাবিধ রোগ দ্বারা পিড়ীত হয় বা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু যতক্ষণ শরীরের অভ্যন্তরে এই দোষসমূহ সাম্যবস্থায় বিরাজ করে ততক্ষণ পর্যন্ত শরীর সুস্থ থাকে।

এই তিনটি দোষ হলঃ
১) বাত (বায়ু)
২) পিত্ত (অগ্নি)
৩) কফ (জল)

একটি সুস্থ শরীরে এই তিনটি দোষের ভারসাম্য বজায় থাকে। অসুস্থ অবস্থায় দেখা যায় শরীর অভ্যান্তরে এই দোষসমূহের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।

এই তিনটি দোষের মধ্যে বাত বা বায়ুর কাজ শারীরিক গতির সঞ্চালন ও নিয়ন্ত্রণ করা।
পিত্ত বা অগ্নি এর কাজ পাচন কার্য সম্পাদন ও পাচিত দ্রব্যের পুষ্টি শোষণ দ্বারা শরীরের কোষ কলার পরিপুষ্টি সাধন করা। আর কফ বা জলের কাজ শরীরে রসের সঞ্চার করা।

গর্ভাবস্থায় গর্ভীনির শরীরে যদি এই তিনটি দোষের সাম্যবস্থা বিরাজ করে তাহলে শিশু সুস্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। অন্যথায় শিশুর শারীরিক বিকাশ সঠিকভাবে হয়না অথবা গর্ভপাতের সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে। তাছাড়া গর্ভবতী মায়ের এই তিনটি দোষের কোন একটি দোষের আধিক্য থাকলে সেই দোষের অনুকরণে শিশুর শারীরিক বিকাশ, স্বভাব ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশ হতে দেখা যায়।

সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|
Ayurveda
বাতঃ শরীরে বাতের আশ্রয়স্থল হলো নাভির নিচের অংশ, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, হাড়, জংঘা প্রভৃতি।
বাত- রুক্ষ, শীতল, লঘু, সূক্ষ, চঞ্চল, বিশদ ও খর এই  ভৌতিক গুণাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। বাত ধাতুতে আকাশ ও বায়ু এই মহাভূতের প্রাধান্যতা থাকে।
ব্যাক্তির কল্পনাশীলতা, বুদ্ধিশীলতা, উল্লাস, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি গুণাবলী বজায় থাকে শরীর অভ্যান্তরে বাত ধাতুর ভারসাম্য থাকার ফলে। আর এই বাত ধাতু শরীর অভ্যন্তরে সাম্যবস্থায় অবস্থিত না থাকলে ওজন হ্রাস, শক্তি হ্রাস, ক্রোধ, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি উৎপন্ন করে। কোষ্ঠবদ্ধতা, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, মানসিক বিকার ইত্যাদি রোগও তৈরি হতে পারে শরীরে বাত ধাতুর সাম্যবস্থা না থাকলে। বাত ধাতুর ক্রিয়ায় শরীরের সংকোচন-প্রসারণ, উৎকর্ষ, অন্তর্নয়ন, বহির্নয়ন, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রভৃতি কার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।
রক্ত সঞ্চালন, রক্তস্রাব, মল-মূত্র বিসর্জন, পাচন, হৃদস্পন্দন,  প্রভৃতি কাজ বাত ধাতুর দ্বারা সম্পাদিত হয়।
বাত ধাতু পাঁচ প্রকারঃ
১) প্রাণঃ প্রাণবায়ু মস্তক ও বক্ষ স্থানে অবস্থান করে। এটি মস্তিষ্ককে সমস্ত প্রকার কার্যাবলী সম্পাদন করতে সাহায্য করে থাকে।

২) উদানঃ উদান বায়ু বক্ষস্থলে অবস্থান করে। এই বায়ু কণ্ঠস্বরের প্রকাশ কার্যাবলী সম্পাদনে সাহায্য করে।

৩) ব্যানঃ এটি সমস্ত শরীরে অবস্থান করে। শরীরের বিকাশ ও গতি কে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই বায়ু।

৪) সমানঃ সমান বায়ু ক্ষুদ্রান্ত্রে ও বৃহদান্ত্রে অবস্থান করে। এটি খাদ্যের পরিপাক ও মল এদের দুজনকে পৃথক করে সঞ্চালিত করে থাকে। শরীরের তাপ, দ্রব্যপদার্থ, পিত্ত ও কফ এর কাজ কে নিয়ন্ত্রণ করে।

৫) অপানঃ অপান বায়ু মূত্রাশয়ে অবস্থান করে। এটি মল-মূত্র ও বীর্যকে নিষ্কাশন করতে সাহায্য করে। এটি স্ত্রীলোকেদের মাসিক ধর্মকেও নিয়ন্ত্রণ করে।

বাত প্রধান ব্যক্তির শরীর কমজোরী, হালকা-পাতলা গড়নের হয়ে থাকে। ত্বক ও কেশ রুক্ষ, চোখ শুষ্ক, চঞ্চল স্বভাবের হয়ে থাকে এরা এবং মানসিকভাবে কমজোরি ধরনের হয়। সামান্য শ্বাস, গলা ব্যথা, চোখ, কান, নাক, মানসিক বিকার ইত্যাদি জাতীয় রোগে এরা প্রায়ই ভুগে থাকে।

পিত্তঃ পিত্তের আশ্রয়স্থল হলো বক্ষ, নাভির মধ্যভাগ, ঘাম, রক্ত, পরিপাকস্থল, মূত্রাশয় ও নালী। পিত্ত পাচন ক্রিয়া, রসায়নীকরণ, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতির কার্যকলাপকে সঞ্চালন করে থাকে। শরীর অভ্যন্তরে যদি পিত্ত নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে বিশ্বাস উদ্দমশীলতা, কর্মশীলতা, আহ্লাদপূর্ণতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। আর এটির বিশৃঙ্খলা ঘটলে বা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে জঠরাগ্নি নিস্তেজ হয়ে যায়। ফলে পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে না। শারীরিক দুর্বলতা, প্রদাহ, জ্বর ও নানাবিধ অসুস্থতা দেখা দেয় তখন। অনেক সময় শরীরে জ্বালাপোড়া দেখা দেয়, শরীরে মেদের আধিক্য ঘটে, অজীর্ণতা, মধুমেহ এছাড়াও নানা ধরনের মানসিক ব্যাধি উন্মাদতা ইত্যাদি রোগের সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃত কথা পিত্ত শরীর অভ্যন্তরে অগ্নি স্বরূপ হয়ে পাচন কার্য সম্পন্ন করে।

পিত্ত পাঁচ প্রকারঃ
১) আলোচক পিত্তঃ এই পিত্রাশীষ তাল হল চোখ চোখের রং ও দর্শন শক্তি এই পিত্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়।
২) সাধক পিত্তঃ এই পিত্তটির অবস্থান হার্টে। উৎসাহ-উদ্দিপনা, বুদ্ধিগত কার্যাবলী, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদিতে এই পিত্ত ভূমিকা রাখে।
৩) ভ্রাজক পিত্তঃ এটির আশ্রয় স্থল হলো ত্বক। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ত্বকের রঙ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে ও সৌন্দর্যতা প্রকাশ করে থাকে।
৪) পাচক পিত্তঃ এই পিকটি ক্ষুদ্রান্ত্রে থাকে এটি খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে।
৫) রঞ্জক পিত্তঃ এটি যকৃৎ ও মূত্রাশয়ে অবস্থান করে। শরীরে রক্ত সৃষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

পিত্ত প্রধান ব্যক্তি শারীরিক রূপে মধ্যম আকৃতি, উষ্ণ শরীর যুক্ত, অধিক ঘর্মাক্ত, রক্তিম নেত্র বিশিষ্ট, অল্প কেশ বিশিষ্ট ও কোমল শরীর বিশিষ্ট হয়ে থাকে। পিত্ত প্রধান ব্যক্তির শরীরের রং কালো হয়ে থাকে। সাধারণত এদের মুখে তিক্ত ভাব, নেত্রবিকার, চর্মরোগ, মানসিক রোগ ইত্যাদি হয়ে থাকে।

পিত্ত মানব শরীরে উষ্ণতা প্রদান করে, শরীরের রং প্রদান করে, পরিপাক ক্রিয়া ও পুষ্টি সংবর্ধন করে থাকে।

কফঃ মানব শরীরের জলীয় অংশ হলো কফ। আমাদের শরীরে কফ এর আশ্রয় স্থল হল বক্ষস্থল, কন্ঠ, কন্ঠের উপরিভাগ,  ঘাড়, মস্তক,  হাড়ের সন্ধিস্থল ও উদরের উপরিভাগ, ও শরীরের মেদ ধাতু। কফ গুরু, শীতল, মৃদু, স্নিগ্ধ, মধুর, স্থির ও পিচ্ছিল লক্ষণযুক্ত। কফ ধাতুতে জল ও পৃথ্বী এই দুই মহাভূতের প্রধান্যতা বিদ্যমান থাকে।

শরীর অভ্যন্তরে কফের অসাম্যবস্থায় শরীরের উষ্ণতা হ্রাস পায়, মেদ বৃদ্ধি পায়, অজীর্ণতা, মধুমেহ, আমবাত প্রভৃতি বহু প্রকারের রোগ দেখা দিয়ে থাকে। আর এটির সাম্যবস্থায় মানব শরীরে শান্তি, সহনশীলতা, মননশীলতা, সাহসিকতা, সহানুভূতি, স্নেহ ইত্যাদি বসবাস করে।

এজন্যই-
স্বাভাবিক কফকে শরীরের বল,
আর বিকৃত কফকে শরীরের মল,
-বলা হয়ে থাকে।

প্রাকৃতিক কফকে ‘ওজ’ ও বিকৃত কফকে ‘পাপ’ বলে।

কফ পাঁচ প্রকারঃ
১) তর্পক কফঃ মস্তক অংশে এই কফের অবস্থান। এটি মস্তিষ্ক তথা জ্ঞানেন্দ্রিয়কে তাদের যথাযথ কার্যকলাপ সম্পাদনে সহযোগিতা করে।
২) বোধক কফঃ এই কফের অবস্থান জিহ্বা ও খাদ্যনালীতে। এটি খাদ্যের স্বাদ বোধনে সহায়তা করে।
৩) অবলম্বক কফঃ এটির অবস্থান হার্টে। এটি হার্টকে সুচারুরূপে তার কার্যসম্পাদনের সহযোগিতা করে।
৪) ক্লেদক কফঃ এটির অবস্থান শরীরের উদর অংশে। খাদ্যদ্রব্য ভোজন কালে চর্বণ ও পেশন দ্বারা তা যখন ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হয় তখন ক্লেদক কফ ভোজনকে আদ্রতা ও তরলতা প্রদান করে।
৫) শ্লেষ্মক কফঃ সমস্ত অস্থির সন্ধিস্থলে এটির অবস্থান। শরীরের সমস্ত অস্থিকে এটি দৃঢ়তা ও শক্তি প্রদান করে।

কফ প্রধান ব্যক্তি সুন্দর দর্শন, শারীরিকভাবে বলবান, সুন্দর কেশ বিশিষ্ট, বড় বড় ও সুন্দর নেত্রযুক্ত, ধীরে ভোজনকারী ও নিদ্রালু স্বভাব বিশিষ্ট ইত্যাদি হয়ে থাকে।

সাধারণত ক্ষুধার উদ্রেক না হওয়া, শরীর ভারী বোধ হওয়া, স্থূলতা, অলসতা, স্মৃতি শক্তির বিনাশ, অস্থিসন্ধিতে বেদনা ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। কফ প্রধান ব্যক্তি বর্ষা ও শীত ঋতু প্রতিকূল পরায়ন হয়ে থাকে।

অর্থাৎ বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিন ধাতু শরীর অভ্যন্তরে সাম্যবস্থায় বিরাজ করলে ও তাদের সহাবস্থান নিশ্চিত হলে শরীর সুস্থ থাকে। আর এদের বিশৃঙ্খলাতে শরীরে রোগ উপদ্রব শুরু হয় ও শরীর পিড়ীত হয়। তাই এই সকল ধাতুর সাম্যবস্থাকেই আদর্শ স্বাস্থ্য বলে।

(বিঃদ্রঃ বিষয়টি সম্বন্ধে লিখতে আমি ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন আর্টিকেলের সহযোগিতা নিয়েছি।)

—————————
ডাঃ দীপংকর মন্ডল
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ
৩০/০১/২০২২
Dr. Dipankar Mondal
Dr. Dipankar Mondal
আমি ডা. দীপংকর মন্ডল। রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ। যেকোন নতুন ও পুরাতন রোগের চিকিৎসা করার জন্য যোগাযোগ করুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments