Sunday, May 19, 2024
Homeআয়ুর্বেদআয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূলতত্ত্ব

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূলতত্ত্ব

আয়ুর্বেদ কি?

আয়ু বা সংস্কৃতে আয়ুস শব্দ দ্বারা জীবন এবং বেদ শব্দ দ্বারা জ্ঞান কে বোঝায়। অর্থাৎ আয়ুর্বেদ হল জীবন জ্ঞান বা জীবনবিদ্যা। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় শুধুমাত্র ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়। পবিত্র বেদের একটি খণ্ড ‘অথর্ববেদ’। এই অথর্ববেদের একটি অংশে চিকিৎসাবিদ্যার বর্ণনা আছে। এটিই হলো আয়ুর্বেদ।আয়ুর্বেদ চিকিৎসা এখন থেকে প্রায় ৫০০০ বছরের পুরাতন। এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবন যাত্রার প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়। আয়ুর্বেদের উদ্ভব নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি রয়েছে। একটি মত এই যে- ধন্বন্তরি বা দিবোদাস ব্রমমার কাছ থেকে আয়ুর্বেদ লাভ করেন। আরেকটি মত এই যে মুনির হারিয়ে যাওয়া রচনা এর অবদান আয়ুর্বেদ।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূল তত্ত্বঃ

আয়ুর্বেদের মতে মানব দেহ চারটি মূল উপাদান দ্বারা গঠিত।
সেগুলি হলঃ
১) দোষ।
২) ধাতু।
৩) মল।
৪) অগ্নি।

দোষঃ দোষ উপাদানটি তিনটি মৌলিক বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত। সেগুলি হল বাত, পিত্ত ও কফ। এই দোষগুলি শরীর অভ্যন্তরে সহাবস্থানে বিরাজমান থাকাই হল শারীরিক সুস্থতা। আর এই দোষগুলোর অস্থিতিশীলতায় শরীর অসুস্থ হয়।

ধাতুঃ ধাতু মানব শরীরের বাহক। মানব শরীরে মোট ৭টি ধাতু থাকে। এই ৭টি ধাতু হল- রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা, মেদ, রস, শুক্র। এই ধাতু গুলি দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখে।

মলঃ শরীরের বর্জ্য বস্তুকে মল বলে।
মল তিন প্রকারঃ
১) পায়খানা।
২) প্রস্রাব।
৩) ঘর্ম।

শরীরের বর্জ্য পদার্থ কে যেমন ‘মল’ বলে তেমনি ধাতুর বর্জ্য পদার্থ কে ‘কিত্ত’ বলে।
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এই মল ও কিত্তের সুষ্ঠ বহির্গমন দরকার।

অগ্নিঃ শরীরের টিস্যু অলিভার এ উৎপন্ন একধরণের জৈব-রাসায়নিক হলো অগ্নি’ এটি দেহের পরিপাক ও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

শরীরের গঠন ও প্রকৃতিঃ আয়ুর্বেদ এর মতে আমাদের দেহ এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তু পঞ্চভূত বা পাঁচটি বিশেষ উপাদান দ্বারা গঠিত। এই পঞ্চমহাভূত হলো পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি ও মহাশূন্য। অর্থাৎ এই সব উপাদান গুলি শরীরের মধ্যে যেমন বিদ্যমান তেমনি শরীর রক্ষায় আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তার ভেতরেও এগুলি বিদ্যমান রয়েছে।

আমরা কেন রোগাক্রান্ত হই?

অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যেকোনো কারণে যদি দেহস্ত এই উপাদানগুলি এবং শারীরিক স্থিতির ভারসাম্যে তারতম্য আসে তখন সেই পরিস্থিতিতে আমরা রোগগ্রস্ত হই।
এই ভারসাম্যের তারতম্য ঘটে যে সমস্ত কারণেঃ
১) ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসের অমিতাচার।
২) ইন্দ্রিয়ভোগের অমিতাচার।
৩) অতিমাত্রায় বা ভুল ব্যায়াম বা শারীরিক কসরত।
৪) স্ত্রীলোকেদের ঋতুর গোলযোগ বা অস্বাভাবিকতা।
৫) দেহ ও মনের অমিলপূর্ন ব্যবহার।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাঃ

চিকিৎসকের প্রথম কর্তব্য রোগীকে পুনরায় সুস্বাস্থ্যে আনায়ন করা। অর্থাৎ স্বাস্থ্যরক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ও রোগের উদ্দেশ্যেই চিকিৎসকের সকল প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল হয়। শরীরের অভ্যন্তরে পঞ্চকর্ম যে ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটেছে তার কারণ অনুসন্ধান পূর্বক তা সুস্থ্য অবস্থায় ফেরানোর উদ্দেশ্যেই চিকিৎসককে কাজ করতে হবে।

আর এটি করতে গিয়ে রোগের জন্য ঔষধ, পুষ্টিকর খাদ্য ও রোগের আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ইত্যাদি রোগীর এসবের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগ চিকিৎসায় বা রোগারোগ্যে সাধারণত চারটি উপাদান চিকিৎসক, ঔষধ, পথ্য, উপযুক্ত ক্রিয়া-কলাপ আবশ্যক হয়।

চিকিৎসা পরিচালনার সাথে জড়িত চারটি উপাদানঃ

১) চিকিৎসক।
২) ঔষধ।
৩) পরিচারিকা।
৪) রোগী।

গুরুত্বের দিক দিয়ে চিকিৎসকের স্থান প্রথম। চিকিৎসক তার উপলব্ধি, চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান, মানবিক বোধ, শুদ্ধ মননশীলতা, নম্রতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা মানব জাতির কল্যাণ করেন।

আরো যে সকল বিষয়ের উপরে গুরুত্ব সহকারে নজর রাখতে হবে।
১) সঠিক খাদ্যাভ্যাস।
২) মনো-স্বভাবের উন্নতি দ্বারা সুশৃংখল জীবনযাপন।
৩) ঔষধ গ্রহন।
৪) নিরাময় পঞ্চকর্ম।
৫) রসায়ন চিকিৎসা।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূলতত্ত্ব
Ayurveda

আয়ুর্বেদিক রোগ নির্ণয়ঃ

আয়ুর্বেদিক চিকিতসার ক্ষেত্রে রোগীর রোগ নির্ণয় করা হয় রোগীর শারীরিক ও মানসিক সকল অবস্থার বিচার করে। চিকিৎসক প্রথমত অনুধাবন করার চেষ্টা করেন যে ঠিক কোন অঙ্গটি পিড়িত অর্থাৎ রোগটি কোথায় স্থিত। এরপর অনুভব করার চেষ্টা করেন অসুস্থতা দ্বারা রোগী তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, হজম ক্ষমতা, কোষ, পেশী ও ধাতু ইত্যাদি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।তারপর রোগীর প্রাণশক্তি, ধাতু, রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালি, রোগীর ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা বা পর্যালোচনা করে থাকেন।

এছাড়া রোগ নির্ণয়ে কয়েকটি নিদানগত বা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়ে থাকেঃ
১) সাধারণভাবে শারীরিক পরীক্ষা।
২) নাড়ির স্পন্দন পরীক্ষা।
৩) মল পরীক্ষা।
৪) মূত্র পরীক্ষা।
৫) জিহ্বা ও চক্ষু পরীক্ষা।
৬) চর্ম, কর্ণ, স্পর্শেন্দ্রিয় ইত্যাদির কার্যকলাপ পরীক্ষা।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ধরনসমূহঃ

শোধন চিকিৎসাঃ(বিশুদ্ধিকরন): এ পদ্ধতি দ্বারা রোগীর শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণগুলি দূর করে রোগীর ভেতরে ও বাইরে শুদ্ধিকরণ করা হয়।
এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত মাধ্যমগুলো হলঃ
বমনকারক ঔষধ, বিরেচন, গুহ্যদ্বারে প্রক্ষিপ্ত তৈল/ঔষধ, নাসিকা মধ্যে ব্যবহৃত ঔষধ এছাড়াও কৃত্রিমভাবে ঘর্ম উৎপাদন দ্বারা শরীরের টক্সিন বের করে চিকিৎসা। স্নায়ুরোগে অস্থি ও মাংসপেশির অসুখে, ধমনী সংক্রান্ত অসুস্থতা, শ্বাস-প্রশ্বাস ও পাচধ প্রক্রিয়ার অসুখে এই চিকিৎসা খুব উপযোগী।

শমন চিকিৎসাঃ (প্রশমনকারী চিকিৎসা) যে পদ্ধতি দ্বারা দূষিত দোষ শরীরের পঞ্চকর্মের ভারসাম্য নষ্ট না করে পূর্বাবস্থায় ফেরে তাকে শমন চিকিৎসা বলে। ক্ষুধার উদ্রেক, হজমের ক্রিয়াশীলতা, ব্যায়াম ও আলো-হাওয়ার দ্বারা শরীরকে উজ্জীবিত করা হয়।  এতে রোগ উপশমকারী ঔষধ ও বেদনানাশক ঔষধের ব্যবহার করা হয়।

পথ্য ব্যবস্থাঃ(ক্রিয়া-কলাপ ও খাদ্যভ্যাসের নিয়মাবলী): দৈনন্দিন খাদ্যাভাসের উপর নিষেধাবলী দ্বারা শরীর অভ্যন্তরের অগ্নিকে উদ্দীপিত করা হয়। ফলে হজম প্রক্রিয়া গতিশীল হয় ও খাদ্যবস্তু ভালোভাবে হজম হয় ও তা শরীর পরিপোষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।

নিদান পরিবর্জনঃ(অসুখ হওয়া ও অসুখের বৃদ্ধিকারক কারণগুলির বর্জন): দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণের যে সকল উপাদান দ্বারা শরীর/মন রোগগ্রস্থ হচ্ছে রয়েছে সেগুলোর পরিহার বা পরিত্যাগূর ফলে রোগ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে না।

সত্ববজায়ঃ(মানসিক রোগের চিকিৎসা): মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এটির ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতি দ্বারা রোগীর মনকে অস্বাস্থ্যকর বস্তুর কামনা থেকে মুক্ত রাখা, সাহস যোগানো, স্মৃতিশক্তির বৃদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা ও মনবিজ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।

রসায়ন চিকিৎসাঃ (অনাক্রম্যতা এবং পূনঃযৌবন প্রাপ্তির ঔষধ): রসায়ন চিকিৎসা দাঁড়া মানবদেহে শক্তি ও প্রাণশক্তির আনায়ন করা হয়। অসময়ে শরীরের ক্ষয় প্রতিরোধ করে, শারীরিক দৃড়তা বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তির বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি, যৌবনশক্তি অক্ষুন্ন রাখা এবং শরীর ও ইন্দ্রিয়সমূহের পূর্ণমাত্রায় শক্তি সংরক্ষণ এসব উপকারিতা রসায়ন চিকিৎসা দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়।

পথ্যঃ আয়ুর্বেদে খাদ্যাভ্যাসের নিয়ন্ত্রণ করা চিকিৎসার একটি অনুষঙ্গ। আয়ুর্বেদ অনুযায়ী ধরা হয় যে আমাদের আহার্য খাদ্যের ফলই আমাদের দেহ। অর্থাৎ আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সবই প্রত্যক্ষভাবে আমাদের খাদ্যের মানের উপর নির্ভরশীল। আমাদের আর্য খাদ্যবস্তু হজম হয়ে প্রথমে ‘চাইল’ বা রস এ রূপান্তরিত হয়। তারপর এটি বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া দ্বারা রক্ত, পেশী, চর্বি, হাড়, অস্থিমজ্জা, পুনর্জননের উপাদান এবং ওজাস এ রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ খাদ্যই হল দেহের সব রকম রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ ও জীবনীশক্তির মূল। খাদ্যে পুষ্টির অভাব বা বেঠিক রূপান্তর নানাবিধ রোগের প্রশ্রয়দাতা।

আরো পড়ুনঃ
সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|

ডাঃ দীপংকর মন্ডল
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ
২৬/০২/২০২২

———————————–

Dr. Dipankar Mondal
Dr. Dipankar Mondal
আমি ডা. দীপংকর মন্ডল। রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ। যেকোন নতুন ও পুরাতন রোগের চিকিৎসা করার জন্য যোগাযোগ করুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments