Sunday, May 19, 2024
Homeআয়ুর্বেদসুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|

সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|

সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|

বর্তমান সময়ে সাধারণ জ্বর কাশি সর্দি থেকে শুরু করে জটিল কঠিন ও দূরারোগ্য প্রকৃতির যে সকল রোগ ব্যাধির প্রকোপ দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশই আমাদের স্বেচ্ছাচারী ও অমিতাচার যুক্ত জীবন চর্চার কারণেই সৃষ্ট। আমাদের আহার বিহার যেমন লালসামাখা, জীবনাচরণও তেমনই ছন্দহীন। আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে অসুস্থ করার জন্য এই সকল কারণ সমূহের প্রবল ভূমিকা রয়েছে। যে কোনো সৎ ও মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়নে শারীরিক অসুস্থতাই প্রথম বাধা। শরীর সুস্থ না থাকলে তার প্রভাব মনের উপরে পড়ে তাই আমাদের মনও সুখী হতে পারেনা শরীর সুস্থ নয় বলে। এই কারণেই বলা হয় ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’।

তাই সুখী হতে গেলে আমাদের অবশ্যই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। আর যেহেতু নানাবিধ অনিয়ম পালন করে করে আমরা রোগগ্রস্থ হই তাই আয়ুর্বেদিক(Ayurveda) চিকিৎসা বলছে আমরা বিভিন্ন নিয়ম পালন করে আবারও সুস্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারি। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি রোগের প্রতিকার থেকে রোগ যাতে না হতে পারে সেই দিকেই নজর দেয় বেশি।

তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে আমরা প্রথমত দুই প্রকারের নিয়ম পালন করব-

১) জীবণাচরণে  নিয়মানুবর্তিতা।
২) খাদ্য গ্রহণে সংযম।

শুধুমাত্র এই দুই প্রকার নিয়ম পালন করেই আমরা আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ করে তুলতে পারি। 

সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|
Ayurveda

প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করব জীবন আচরণের নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে। এবং খাদ্যাখাদ্য গ্রহণে বিচার নিয়ে পরবর্তীতে আরেকটি পর্ব করে বিস্তারিত আলোচনা করব। 

যে সকল নিয়ম অতি অবশ্যই পালন করলে আমাদের শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকবে তার আলোচনা আমরা এখানে করব। এই ব্যাপারে আমরা আয়ুর্বেদের সহযোগিতা সহায়তা নিতে পারি।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বলছেন, প্রকৃতিতে তিনটি দোষ আছে যা আমাদের শরীর অভ্যন্তরে কাজ করে। শরীর অভ্যন্তরে এই তিনটি দোষ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকলে আমরা যথাসম্ভব সুস্থ থাকি। আর এরা ভারসাম্যহীন হলে তখন আমরা সেই অনুপাতে অসুস্থ হই। এই তিনটি দোষ হলো বাত, পিত্ত ও কফ। এই দোষ গুলির প্রধান কাজ হচ্ছে আহার করা খাদ্যদ্রব্যের সার বা পুষ্টিমান শরীরের সকল কোষে পৌঁছে দেয়া। এই দোষগুলি ভারসাম্যহীন হলে শরীরে অসুখ দেখা দেয়।

এই তিনটি দোষকে বিবেচনায় রেখে দিনচর্যা বা দৈনিক রুটিন এর ব্যাপারে এখন আলোচনা করছি।

ব্রহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগঃ সূর্যোদয়ের ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট পূর্বে শুরু হয়ে সূর্যোদয়ের ৪৮ মিনিট পূর্ব পর্যন্ত সময় কালকে ব্রহ্মমুহূর্ত বলে। এই মুহূর্তেই শয্যা ত্যাগ করতে হবে। মন শুদ্ধির জন্য, যিনি যেই মতপথের অনুসরণ করেন তিনি সেই সেই প্রার্থনামূলক সেবা কর্মের দ্বারা দিন শুরু করবেন। এরপর কিছুটা সময় তিনি হালকা যোগ ব্যায়ামের অভ্যাস করবেন। কোন সৎ ও মহত্তর চেতনার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণ মেডিটেশন বা ধ্যান করতে পারেন এই সময়ে। এতে মানসিক নির্মলতা আসবে।

সকালে স্নানঃ শরীরে বর্জ্য পদার্থ বা আবর্জনা আছে। এই আবর্জনা বা বর্জ্য দুই প্রকারের হয়। শরীরের আবর্জনা(মল) ও মনের আবর্জনা (কিত্ত)। আধ্যাত্মিক ক্রিয়া-কলাপ দ্বারা যেমন মনের আবর্জনা(কিত্ত) দূরীভূত হয় তদ্রূপ স্নানের দ্বারা শরীরের মলও দূরীভূত হয়। শরীর পরিছন্ন রাখতে দৈনিক অন্তত দুইবার স্নান করা অপরিহার্য।

স্বাস্থ্যকর আহারঃ খাদ্যাখাদ্য বিবেচনা পূর্বক শরীরের উপযোগী আহার পরিমিত মাত্রায় গ্রহণের অভ্যাস করতে হবে। আহার দ্বারা শরীর বল গ্রহণ করে। মনে রাখতে হবে আমরা বাঁচার জন্য খাই, খাওয়ার জন্য বাঁচিনা।

কর্মঠ জীবনযাপনঃ অলসতা পরিত্যাগপূর্বক কর্মময় জীবন যাপন করতে হবে। পেশাদার কর্মে সৎ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ দ্বারা সংসার পরিচালনার জন্য অর্থ উপার্জন করতে হবে। মহৎ উদ্দেশ্য ধারণ করে সৎকর্মে রত থাকতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের জন্য কল্যাণমূলক কর্মে আত্মৎস্বর্গে রত থাকতে হবে।

পর্যাপ্ত বিশ্রামঃ বিশ্রাম কাজের অঙ্গ। তাই পরিশ্রমের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম গ্রহণ করলে শারীরিক উৎসাহ বজায় থাকে। একটি কুঠারে ধার না দিয়ে অবিশ্রান্ত ভাবে তা ব্যবহার করলে তার দ্বারা খুব বেশি কাজ করা যায় না। মাঝে মাঝে তাকে ধার দিয়ে ব্যবহার করলে অধিক কাজ করা যায়। তদ্রূপ বিশ্রাম দ্বারা আমরা শরীরকে অধিক শক্তি প্রদান করে অধিক কর্ম সম্পাদন করতে পারি।

পরিবারের সাথে সময় কাটানোঃ পরিবারের সকলের সাথে সময় কাটানো অতি আবশ্যক। তাতে পারিবারিক বন্ধন যেমন মজবুত হয় তেমনি তাতে জীবনযাপনে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটালে মন অধিক প্রফুল্ল হয়। পরিবারে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তি থাকলে তাদের সেবাযত্ন ও খোঁজখবর নেওয়া প্রত্যেকেরই নৈতিক দায়িত্ব।

ইলেকট্রিক ডিভাইসের মার্জিত ব্যবহারঃ বর্তমানে মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এই সকল ইলেকট্রিক ডিভাইস আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এদেরকে বাদ দিয়ে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চলা সম্ভব নয়। তবে এই সকল ইলেকট্রিক ডিভাইসের মার্জিত ব্যবহার দ্বারা এগুলোর সর্বোচ্চ সুবিধা আমরা আদায় করে নিতে পারি।

পুস্তক পাঠঃ আমাদের জীবনে প্রাপ্ত সকল কিছু থেকে বিশেষভাবে মূল্যবান হলো জ্ঞান। বলা হয় জ্ঞান অমূল্য সম্পদ। আর এই জ্ঞান পুস্তক পাঠ দ্বারা আমরা অর্জন করতে পারি। অর্জিত সেই  জ্ঞান দ্বারা  উচ্চতর আদর্শ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। বই পড়া একটি সখও হতে পারে।

সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব|
Ayurveda

শখের অনুশীলনঃ পুস্তক পাঠ, বৃক্ষরোপণ, ফুলের বাগান করা, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত চর্চা, নৃত্য চর্চা এরকম আরো কোন গঠনমূলক শখের অনুশীলন করা যেতে পারে। এই সকল সাথের অনুশীলন মানসিক আনন্দের উৎস হতে পারে। এগুলো ব্যক্তি জীবনের জন্য সঙ্গীও হতে পারে। বলা হয় সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। এই প্রসঙ্গে বলা যায় একটি পুস্তক নির্বাচন একজন সঙ্গী নির্বাচনের সমান হতে পারে।

সন্ধ্যার পর ভারী আহার না করাঃ আয়ুর্বেদ অনুসারে সন্ধ্যা ৬ টার পর থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত এই সময়টাতে পিত্তযযযয দোষের আধিক্য বেশি থাকে। ফলে এই সময়ে আমাদের হজমশক্তি দুর্বল থাকে। শরীরে পরিপাক ক্রিয়া ভালো হয়না। তাই এই সময়ে অধিক আহার করলে শরীর শক্তিলাভের পরিবর্তে দুর্বল হয়।

‘পিত্ত’ দোষের পূর্বে ঘুমতে যাওয়াঃ সাধারণত রাত্রি ১০ টা থেকে পিত্ত দোষের শুরু হয়। রাত ১০ টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ‘পিত্ত’ দোষের সময়কাল। এই সময়টা অবশ্যই ঘুমাতে হবে। এবং রাত্রি ১০ টার পূর্বে অবশ্যই বিছানায় ঘুমাতে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে রাত ১০ টা থেকে রাত ২ টা পর্যন্ত না ঘুমিয়ে তার পরবর্তী ৮ ঘন্টা সময় কাল পর্যন্ত ঘুমালেও শরীর ক্লান্ত থেকে যায় এবং সারাদিন অসুস্থতা বিরাজ করে।

এভাবে দৈনিক রুটিন বা দিনাচর্যা সাজালে আমরা নানাবিধ সুফল প্রাপ্ত হব। যে সকল সুবিধা আমরা প্রাপ্ত হব নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করছি।

১) ‘দোষ’ গুলির সাম্যবস্থা।
২) ভালো হজম।
৩) সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
৪) সুস্থ জীবন।
৫) মানসিক প্রশান্তি।
৬) প্রকৃতির সাথে সুসামঞ্জস্যতা।

অর্থাৎ আয়ুর্বেদের মূল যে ভিত্তিগুলো পালনের জন্য এই সকল বিষয়ের আলোচনা করা হল সংক্ষেপে তা হলঃ 

১) স্বাস্থ্য পরিচর্যা।
২) যোগ ও ধ্যান।
৩) আহার মূল্যায়ন ও সেবা।
৪) রোজগারের নির্দেশনা।
৫) প্রকৃতি/সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক।

নিয়মের বন্ধন অনেক সময় আমাদের মানসিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথে বাধা মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে আমরা অনুভব করতে পারবো যে একমাত্র নিয়ম, শৃঙ্খলা বা সংযমের বন্ধন দ্বারাই আমাদের মানসিক মুক্তি সম্ভব। একটি ফুটবল মুক্ত হয়ে সকলের পদদলিত হয়ে লাথি খায়। কিন্তু সুতো দ্বারা একটি ঘুড়ি আবদ্ধ থাকলেও সে আকাশে ওড়ে। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে বন্ধনই মুক্তির কারণ। তাই আমরা শৃঙ্খলা ও সংযম দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার শুভ কামনা করতেই পারি।

যেকোনো কঠিন কর্মও অবিরত অভ্যাস দ্বারা রপ্ত করা যায় যদিও তা প্রাথমিক অবস্থায় কঠিন বা অসাধ্য বলে মনে হয়। শরীর রক্ষার স্বার্থে প্রতিদিন কিছু কিছু করে অভ্যাস পালন করা যায়। খুব দ্রুত হয়ত কোন অভ্যাস গড়ে উঠবে না। কিন্তু ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে নিশ্চয়ই সদঅভ্যাস গুলি ধীরে ধীরে স্থান পাবে আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে ও প্রতিদিনের কাজকর্মে।

এখন আমরা আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নত্তর নিয়ে আলোচনা করব।

প্রশ্নঃ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জনক কে?

উত্তরঃ সংস্কৃত ‘আয়ুষ’ শব্দের অর্থ ‘জীবন’ এবং ‘বেদ’ এর অর্থ ‘ বিশেষ জ্ঞান’ বা ‘বিজ্ঞান’। অর্থাৎ আয়ুর্বেদের অর্থ ‘জীবনের বিজ্ঞান’। 

প্রশ্নঃ আয়ুর্বেদের উৎস কোন বেদ?

উত্তরঃ আয়ুর্বেদ হল একটি উপবেদ বা সহায়ক জ্ঞান। মূলত ‘অথর্ববেদ’ থেকে ‘আয়ুর্বেদ শাস্ত্র’ এসেছে। অথর্ববেদ এ আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ১১৪ টি স্তোত্র রয়েছে। আয়ুর্বেদের উদ্ভব নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। একটি মত অনুযায়ী ব্রহ্মার থেকে ধন্বন্তরি(দিবোদাস) আয়ুর্বেদের জ্ঞান লাভ করেন।

প্রশ্নঃ আয়ুর্বেদিক ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?

উত্তরঃ সাধারণত আয়ুর্বেদিক ঔষধ গুলো ভেষজ গাছ গাছড়া ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ঔষধের ভুল প্রয়োগ হলে কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তবে সাধারণত ভেষজজ উদ্ভিদ থেকে এই আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি হওয়াতে আয়ুর্বেদিক ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব গুরুতর প্রকারের কিছু হয় না

প্রশ্নঃ মানব দেহের চারটি মূল উপাদান কি কি?

আয়ুর্বেদ অনুসারে মানব দেহের চারটি মূল উপাদান হল দোষ, ধাতু, মল এবং অগ্নি। এগুলোকে আয়ুর্বেদের ‘মূল সিদ্ধান্ত’ বা ‘আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূলতত্ব’ বলা হয়।

সকলের জন্য শুভকামনা রইল। ভালো থাকবেন সবাই।

আরো পড়ুনঃ
বাত পিত্ত ও কফ এই ত্রিদোষ জাত অর্থ কি?

ডাঃ দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
২২.০১.২০২৪

—————————-

Dr. Dipankar Mondal
Dr. Dipankar Mondal
আমি ডা. দীপংকর মন্ডল। রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ। যেকোন নতুন ও পুরাতন রোগের চিকিৎসা করার জন্য যোগাযোগ করুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments