Sunday, May 19, 2024
Homeপ্রাকটিস অব মেডিসিননাকের পলিপাস হোমিওপ্যাথিতে আরোগ্য হয়

নাকের পলিপাস হোমিওপ্যাথিতে আরোগ্য হয়

ভূমিকাঃ একুইট এবং ক্রনিক নানা ধরনের নাকের রোগ নিয়ে অনেকেই ভুগে থাকেন। পলিপাস বা ন্যাজাল পলিপ তার মধ্যে অন্যতম। আজকে আমি পলিপাস সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করব।  যেমন, নাকের পলিপাস কি? পলিপাস কেন হয়? পলিপাস এর লক্ষণ? পলিপাসের হোমিও চিকিৎসা ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

নাকের পলিপাস কি?

অনেক সময় নাকের ভেতর মিউকাস মেমব্রেন বা ঝিল্লিতে নরম বেদনাহীন ফোলা বা গুটিকা দেখা যায়। এটি এলার্জিক কারণে কখনো কখনো খুব বেড়ে গেলে তখন নাক বন্ধ হওয়া, সর্দি, হাঁচি মাথাব্যথার মত লক্ষণ দেখা দেয়। এই গুটিগুলোকেই পলিপাস বলে। দীর্ঘদিনের ক্রনিক এলার্জি, সাইনাসের সংক্রমণ, সাইকোটিক ম্যানিফেস্টেশন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে রোগটি হতে পারে।

নেজাল পলিপ এক ধরনের ইডেমেটাস ডিজিজ। নাকের ভিতর Cell এবং Blood vessels এর মাঝে যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেখানে ফ্লুইড জমে। এর ফলে নাকের ভেতরে Mucus membrane এবং Paranasal sinus ফুলে গিয়ে পলিপাসের আকার নেয়। 

সাধারণত কোন প্রকার এলার্জি থেকে পলিপাস রোগটি হতে পারে। এছাড়া নাকে কোন প্রকার ইনফেকশন, ইনফ্লামেশন, কোন টিউমার যেমন প্যাপিলেমা, হেমান্জিওমা ইত্যাদি থেকেও পলিপাসের ন্যায় রোগ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় কোন ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকেও পলিপাস রোগটি হতে পারে।

নাকের পলিপ কত প্রকার? 

সাধারণত দুই ধরনের নাকের পলিপ দেখা যায়ঃ

১) ইথময়েড পলিপ (Ethmoid polyp)
২) এন্ট্রোকোয়ানাল পলিপ(Antrochoanal polyp)

ইথময়েড পলিপঃ সবচেয়ে সাধারণ ধরনের নাকের পলিপ হল ইথময়েড পলিপ। এটি ছোট ছোট আকারের হয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের থলির ন্যায় একাধিক পলিপ এক স্থানে থাকে। নাক ও চোখের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ইথময়েড সাইনাস থেকে উৎপত্তি হয়। এটি সাধারণত হয়ে থাকে এবং ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজনদের ভিতরেই সাধারণত এই ধরনের পলিপ বেশি দেখা যায়। এই ধরনের পলিপ একইসাথে দুই নাকেই (Bilateral) হয়ে থাকে।

এন্ট্রোকোয়ানাল পলিপঃ দাঁতের উপরে এবং নাকের নিচে এই অবস্থানে ম্যক্সিলারি সাইনাস থেকে এই পলিপের উৎপত্তি। এই প্রকারের পলিপ আকৃতিতে ইথময়েড পলিপের থেকে বড় হয়ে থাকে। সাধারণত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের পলিপ বেশি দেখা যায়। এটি সাধারণত এক পাশের নাকে(Unilateral) হয়ে থাকে।

সতর্কতাঃ আমরা Turbinate hypertrophy কে নাকের পলিপাস ভেবে যেন ভুল না করি। যদি প্রকৃতই টার্বিনেট বৃদ্ধি পায় তবে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। নাকের ভিতর টর্চ ধরলে একদম প্রথমে যেটা চোখের সামনে আসে তা হল টার্বিনেট, পলিপাস নয়! এই টার্বিনেট স্বাভাবিকভাবে সকলের নাকেই জন্মগতভাবে থাকে। এটি বৃদ্ধি হলে কখনো কখনো সার্জারির প্রয়োজন পারে। 

নাকের পলিপাস কেন হয়? 

পলিপাস রোগটি নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে। প্রধান প্রধান কারণ গুলো হল এলার্জিক সমস্যা, এলার্জি রাইনাইটিস, ডাস্ট এলার্জি বা এ জাতীয় সমস্যা থেকে ন্যাজাল পলিপ হয়ে থাকে।

ক্রনিক সাইনোসাইটিসঃ দীর্ঘদিন যাবৎ ক্রণিক আকারে সাইনাসের প্রদাহে ভুগতে থাকলে তার থেকেও পলিপ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও নাকের কোন ক্রনিক ইনফেকশন থেকেও রোগটি হতে পারে।

সিস্টিক ফাইব্রোসিসঃ এটি একটি জিনগত অসুবিধা। রোগটি শরীরে ঘন শ্লেশ্মা তৈরি করে এবং বিভিন্ন অঙ্গে তা জমা হয়। এই রোগটি থেকেও ন্যাজাল পলিপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শ্বাসকষ্টের সমস্যাঃ যাদের শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা আছে কিছু ক্ষেত্রে তাদেরও এই রোগটি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

পারিবারিক ইতিহাসঃ পারিবারিকভাবে এই রোগ হওয়ার ইতিহাস থাকলে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে।

তবে সব থেকে বড় কথা হল সাইকোটিক মায়াজম শরীরে এই রোগটিকে হওয়ার জন্য প্রণোদনা দেয়। 

এছাড়াও সেপ্টাল ডেভিয়েশন, সাইকোটিক গ্রোথ আরো নানা কারণ থেকে নাকে পলিপাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

নাকের পলিপাস এর লক্ষণঃ

নাকে পলিপাসের ক্ষেত্রে প্রায়ই কিছু কমন লক্ষণ দেখা যায়। 

সর্দিঃ নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, কখনো কখনো নাক ফুলে যায়, এর সাথে নাকের সর্দি থাকতে পারে। কখনো কখনো প্রচন্ড হাঁচি হতে পারে।

মাথা ব্যাথাঃ নাকের পলিপাস এর সমস্যা তে সাধারণত প্রায়ই প্রচন্ড মাথা ব্যথা থাকতে দেখা যায়। অর্থাৎ পলিপাস বাড়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

ঘ্রাণ শক্তির লোপ পাওয়াঃ নাকে গন্ধ বা সাধের অনুভূতি হ্রাস পায়। 

চোখ জ্বালাপোড়া করাঃ নাকের নানা সমস্যার সাথে অনেক সময় চোখে জ্বালাপোড়া করে থাকে। 

এই সকল লক্ষণগুলো নাকে পলিপের ক্ষেত্রে কমন ভাবে দেখা যায়। এছাড়াও এই রোগের অনুষঙ্গ হিসেবে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা, শ্বাসকষ্টের কারণে ঘুমাতে কষ্ট হওয়া, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, কানে ব্যথা, ক্লান্তি ও দুর্বলতা সহ কখনো কখনো জ্বর দেখা দিতে পারে।

নাকের পলিপাস নির্ণয়ঃ

নাকের পলিপাস নির্ণয়ে বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বা নাক, কান ও গলা(ENT) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাকের ভেতর পরীক্ষা করে রোগটি নির্ণয় করতে পারেন।

এন্ডোস্কোপিঃ এন্ডোসকপি এর সাহায্য নিয়ে নাকের পলিপ খুব সুন্দরভাবে নির্ণয় করা যায়।

সিটি স্ক্যানঃ নাকের ভিতর সিটি স্ক্যান করে নাকের পলিপ নির্ণয় করা যায়।

এমআরআইঃ এই পরীক্ষা দ্বারা নাকের ভেতর ছবি করে সহজে রোগটি নির্ণয় করা যায়।

রাইনেস্কোপ (Rhinoscope) নামক যন্ত্রের সাহায্যে যেকোনো প্রকারের মেজাল পলিপ পরীক্ষা করা যায়।

নাকের পলিপাস হোমিওপ্যাথিতে আরোগ্য হয়
নাকের পলিপাস এর ছবি

নাকে পলিপাস প্রতিরোধঃ

পলিপাস প্রতিরোধ করতে আমরা নিম্নত্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।

এলার্জি নিয়ন্ত্রণঃ যে কোন প্রকার এলার্জি থাকলে বিশেষত ডাস্ট এলার্জি থাকলে তা প্রতিরোধ করতে হবে।

নেশা পরিত্যাগঃ তামাকজাত কোন নেশা থাকলে বিষেষ করে ধূমপান পরিত্যাগ করলে নাকের পলিপ প্রতিরোধ করা সহজ হবে।

নাক পরিষ্কার রাখাঃ নিয়মিত নাকের ভেতর পরিষ্কার করতে হবে। তাতে পলিপের ঝুঁকি কিছুটা কম হবে।

নাকের পলিপাসে চিকিৎসাঃ

নাকের পলিপাস হলে করণীয় কি ?

পলিপাসের আকার এবং উপসর্গের তীব্রতার উপর নির্ভর করে নাকের পলিপাসের চিকিৎসা করতে হয়। পলিপাস প্রাথমিক অবস্থায় ছোট থাকলে ঔষধের দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে। আর পলিপ খুব বড় হয়ে গেলে এবং ঔষধে এটা না কমলে সার্জারির মাধ্যমে পলিপাস অপসারণ করা যেতে পারে।

নাকের পলিপাসের হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যদি রোগীর লক্ষণ সাদৃশ্য নির্বাচন করা যায় তবে খুব সুন্দর কাজ করে। নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে সঠিক শক্তি এবং মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারলে নাকের পলিপাসের চিকিৎসায় সফল হওয়া যায়। যেহেতু শরীরে সকল রকমের প্রলিফারিশন বা গ্রোথ থেকে সাইকোটিক মায়াজম থেকে উদ্ভূত হয় তাই পলিপাস রোগটির পেছনেও সাইকোটিক নাজমের ভূমিকা রয়েছে। তাই যথাযথভাবে সাইকোটিক মায়াজমের চিকিৎসা হলে বা এন্টিসাইকোটিক চিকিৎসা দ্বারা এই রোগ নির্মূল হওয়া সম্ভব।

থুজাঃ ওষুধটি  লক্ষণ সাদৃশ্যে উচ্চশক্তিতে প্রয়োগে অনেক ক্ষেত্রে পলিপাস রোগ আরোগ্য হয়েছে।

ক্যালকেরিয়া কার্বঃ বিশেষত একটু মোটাসোটা ধরনের বাচ্চাদের নাকের পলিপ এ লক্ষণ থাকলে এই ঔষধটি খুব ভালো কাজ করে। আমার নিজের ব্যক্তিগত প্র্যাকটিসে বেশ কয়েকটি বাচ্চার পলিপাস এ এই ওষুধটি প্রয়োগে আরোগ্য হতে দেখেছি।

নেট্রাম মিউরঃ অতিরিক্ত লবণ প্রিয় রোগা পাতলা শরীরের বাচ্চাদের নেট্রাম মেয়র প্রয়োগে পলিপাস আরোগ্য হতে দেখেছি।

গ্রাফাইটিসঃ মোটাসোটা গড়নের ব্যক্তি, চর্মরোগ প্রবণ, কোষ্ঠবধ্যতা প্রবণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ প্রয়োগে পলিপাস ভালো হয়।

অরাম মেটালিকামঃ পলিপাস বা নাকের ক্ষত উভয় প্রকার রোগ লক্ষণ এই ঔষধটি লক্ষণ সাদৃশ্যে সফলভাবে ব্যবহৃত হয় এবং রোগ আরোগ্য হয়।

মায়াজমেটিক এসব ঔষধ গুলো পলিপাস কে গভীরভাবে ভেতর থেকে নির্মূল করে। এছাড়াও লক্ষণ সাদৃশ্য থাকলে সালফার, সোরিনাম, ব্যাসিলিনাম, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম, সাইলিসিয়া ইত্যাদি আরো যেকোনো ওষুধের সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে।

পলিপাসের তরুণ আক্রমণে যখন নাক দিয়ে জল পড়তে থাকে, প্রচন্ড হাঁচি হয়, চোখ থেকে জল পড়ে তখন রোগ লক্ষণ কমাতে আমি সাধারণত স্যাঙ্গুনেরিয়া নাইট, এপিস মেল, এলিয়ন সিপা, স্যাবাডিলা ইত্যাদি ঔষধ ব্যবহার করে থাকি এবং সুন্দর ফল পাই।

বাহ্য প্রয়োগঃ অনেক সময় রোগ খুব জটিল হলে বা পলিপাসের আকার খুব বড় হলে বাহ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কটন বাড এর অগ্রভাগের তুলা থুজার মাদার টিংচার দ্বারা ভিজিয়ে নাকের ভিতরে নরম করে প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে।

নাকের পলিপাস নিয়ে প্রশ্ন উত্তর পর্বঃ

এই পর্বে আমরা নাকের পলিপাস নিয়ে বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর সম্বন্ধে আলোচনা করব।

প্রশ্ন ১) নাকের পলিপাস অস্ত্রপচারের পর পুনরায় আবার হতে পারে কি?

হ্যাঁ। পলিপাসের অস্ত্র প্রচার করার পর এটি পুনরায় আবার হতে পারে। যেহেতু অস্ত্রপচার দ্বারা শরীরে নিহিত সাইকোটিক রোগবীজ কে দূর করা যায় না। তাই সহসাই পলিপাসের পুনঃ আক্রমণ হতে দেখা যায়।

প্রশ্ন ২) নাকের পলিপাস এসিড দিয়ে পুড়িয়ে আরোগ্য হয় কি?

উত্তরঃ যেভাবে অস্ত্রপাচার করলেও রোগটি ফেরত আসতে পারে সেভাবে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিলেও পলিপাহ রোগটি ফেরত আসতে পারে। তাছাড়া এসিডের বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল রিয়াকশন রয়েছে। এসিড দিয়ে পুড়িয়ে পলিপাস এর চিকিৎসা করলে অনেক সময় নাসারন্ধ্র পুড়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই সাবধান, কখনোই এই অপচিকিৎসা করাবেন না।

প্রশ্ন ৩) মানসিক চাপ কি নাকের পলিপাস বাড়াতে পারে?

উত্তরঃ হ্যাঁ। কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা এসব পলিপাসের সমস্যা কে বাড়াতে পারে।

প্রশ্ন ৪) ধূমপান কি পলিপাসের সমস্যা বাড়ায়?

উত্তরঃ হ্যাঁ। ধূমপান পলিপাসের কষ্টকর লক্ষণগুলোকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ধুমপায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পলিপাসের সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

সতর্কীকরণঃ শুধুমাত্র সাধারণ জ্ঞানমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে এই আর্টিকেলে। নাকের পলিপাস নিয়ে আরো কোন প্রশ্ন থাকলে বা এই বিষয়ে চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

আরো পড়ুনঃ
পলিপাস নাকি পলিপ কোন শব্দটি সঠিক?

ডাঃ দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
২৪.০৩.২০২৪

—————————–

Dr. Dipankar Mondal
Dr. Dipankar Mondal
আমি ডা. দীপংকর মন্ডল। রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ। যেকোন নতুন ও পুরাতন রোগের চিকিৎসা করার জন্য যোগাযোগ করুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments