ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

 ভূমিকা, কাজকর্মের সময়, রান্নাঘরে সবজি কাটার সময়, ধারালো অস্ত্র দ্বারা অন্য কিছু কাটার সময় বা খেলাধুলা করতে গিয়ে অথবা যেকোনো দুর্ঘটনায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেটে যাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। ছোটখাটো কেটে যাওয়া থেকে আঘাতের তীব্রতা অনুযায়ী পরিস্থিতি গুরুতর হতে পারে। অনেক সময় এই আঘাত প্রাণঘাতীও হয়ে থাকে। এইরকম পরিস্থিতিতে দ্রুত ও সঠিক "প্রাথমিক চিকিৎসা" জীবন বাঁচাতে পারে। তাই এই সকল ক্ষেত্রে সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা সম্বন্ধে ধারণা থাকলে তা জীবন রক্ষা করা অথবা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়াতে পারে। 

ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কোথাও কেটে গেলে কি করনীয় সেই বিষয়ে এখন আলোচনা করছি। 

প্রথমত ক্ষতস্থান কে পরিষ্কার করুনঃ

১) সর্বপ্রথম আহত স্থানটি পরিষ্কার করতে হবে।

২) কোন ফরেন বডি বা ময়লা আছে কিনা ভালো করে লক্ষ্য করতে হবে। 

৩) যদি ময়লা বা কোন ধরনের বস্তু থেকে থাকে তবে তা অপসারণ করুন। 

৪) ক্ষতস্থানটি ময়লা, বালি বা ধুলিকনা দ্বারা দূষিত থাকলে তা সাবধানে পরিষ্কার করার জন্য নরম কাপড় ব্যবহার করুন। 

আঘাতের ক্ষত
আঘাতের ক্ষত

৫) যদি জল দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই উষ্ণ গরম জল ব্যবহার করবেন। কখনোই কেটে যাওয়া স্থানে রক্তপাত বন্ধ করতে ঠান্ডা জল বা বরফ ব্যবহার করবেন না। কেননা বরফ বা ঠান্ডা জল রক্তের ক্লট বাড়তে দেয় না।

ফলে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বন্ধ হবে না। তবে রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেলে পরবর্তীতে যদি রোগী আরাম পায় তবে সে ক্ষেত্রে হালকা ঠান্ডা ব্যবহার করা যেতে পারে।

৬) ক্ষতস্থানে সাবান ব্যবহার করবেন না। তাতে জ্বালাপোড়া হতে পারে।

দ্বিতীয়ত রক্তপাত রোধ করুনঃ 

আঘাতে থেতলে যাওয়া বা কেটে গেলে সর্বপ্রথম কর্তব্য রক্তপাত রোধ করা। এই রক্তপাত রোধ করার ক্ষেত্রে কোন ময়লা আবর্জনা থাকলে ক্ষতটি পরিষ্কার করে নিতে হয়। সেটি প্রথমে আলোচনা করা হয়েছে। 

এখন-

১) পরিষ্কার কাপড়ের তুলা নেকড়া দ্বারা চাপ দিয়ে কেটে যাওয়া স্থানের রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। এই সময় এই স্থানে রক্তপাত রোধকারী কিছু ভেষজ যেমন কচি দুর্বার রস, ক্যালেন্ডুলা বা গাদা পাতার রস ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। (তবে কাটা খুব গুরুতর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ ব্যবহার করতে হবে)

২) কেটে যাওয়া স্থান শরীরের থেকে উঁচুতে রাখতে পারলে রক্তের গতি হ্রাস হয়ে তাড়াতাড়ি রক্ত বন্ধ হবে। আঘাত টি হাত বা পায়ে হলে তা হৃদপিন্ডের থেকে উঁচুতে রাখলে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হবে। 

৩) কেটে যাওয়া স্থানটি ব্যান্ডেজ বা গজ দ্বারা ভালো করে বেঁধে দিতে হবে। তবে এই বাঁধনটি খুব বেশি জোরালো হলে তা রক্তের গতিকে আটকাতে পারে। তাই ব্যান্ডেজটি যথাসম্ভব হালকা করে বাঁধুন।

৪) অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যদি রক্তপাত বন্ধ না হয় তবে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের সহায়তা গ্রহণ করুন।

তৃতীয়ত ক্ষতটি ঢেকে রাখুনঃ

১) ক্ষত এর স্থানটি সর্বদা ঢেকে রাখা বা হালকা ব্যান্ডেজ এ বেঁধে রাখতে হবে।

২) ক্ষতস্থানটি ভালোমতো শুকিয়ে না যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই স্থানে জল লাগানো উচিত নয়। ক্ষতস্থানে বারবার জল লাগলে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়।

কিছু বিষয়ে সচেতন থাকুনঃ 

১) ক্ষত খুব গভীর ও কাটা স্থান থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়ে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে প্রয়োজনে টিটেনাস টিকা(Tetanus vaccine) গ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস বা এজাতীয় অন্য কোন সমস্যা থাকলে ক্ষত আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।

আঘাতজনিত ক্ষতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

যেকোনো আঘাত জনিত অথবা কেটে যাওয়া ক্ষতের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিতে খুব সুন্দর ব্যবস্থা আছে। আঘাত জনিত বা কেটে যাওয়া ক্ষেতে ব্যবহারের জন্য ক্যালেন্ডুলার লোশন ও হাইপেরিকাম এর লোশন দুটি কার্যকরী ঔষধ। রক্ত বন্ধ করতে এবং ক্ষতস্থানে পুজ হওয়া বন্ধ করতে এই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গুলো খুবই কার্যকরী। 

বিশেষ করে ছিন্নভিন্ন(Lacerated) এবং কেটে যাওয়া(Incised) ক্ষতে ক্যালেন্ডুলার মতো উৎকৃষ্ট ঔষধ আর নেই। কেটে যাওয়া স্থানে ক্যালেন্ডুলা ঔষধের মাদার টিংচার দ্বারা লোশন প্রস্তুত করে ব্যবহার করলে ক্ষতস্থান খুব দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, ক্ষতস্থানে পূঁজ হতে পারে না এবং ওই স্থানে প্রদাহ হ্রাস পায়। ক্যালেন্ডুলার লোশন ব্যবহারে ক্ষতস্থান দ্রুত শুকিয়ে যায়। কোন অঙ্গের কোমল স্থানে আঘাত দ্বারা ক্ষত হলে যেখানে এমনকি সেলাই দেওয়া সম্ভব নয় সেখানেও ওই স্থান জোড়া লাগিয়ে দেয় ক্যালেন্ডুলার লোশন। 

অতিরিক্ত পূঁজ স্রাব নিবারণ করতে এই ঔষধ অদ্বিতীয়। 

এমনকি দূষিত ক্ষতে জীবনুর জন্ম প্রতিরোধ করে এই ঔষধ। 

এবার হাইপারিকামের বিষয়ে বলি- 

সাধারণ যে সকল ক্ষত দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না সেখানে ক্যালেন্ডুলার ব্যবহারই কর্তব্য। তবে যদি ক্ষত দূষিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় তবে সেখানে হাইপেরিকামের লোশন ব্যবহারই কর্তব্য। দূষিত ক্ষতে প্রথমে ক্যালেন্ডুলা ওষুধটি ব্যবহার করা যাবে না। প্রথমে হাইপারিকামের লোশন ব্যবহার করে দূষিত অবস্থা পার হয়ে গেলে তারপর ক্যালেন্ডুলা ব্যবহার করলে 

দ্রুত ক্ষত আরোগ্য হবে। 

ক্যালেন্ডুলা লোশন তৈরির নিয়মঃ 

ক্যালেন্ডুলা বা হাইপারিকাম এই দুটি ঔষধের ক্ষেত্রেই লোশন তৈরির একই নিয়ম। এক ভাগ ঔষধ এবং দশ ভাগ জলের মিশ্রণ করে লোশন প্রস্তুত করতে হবে। পঁচিশ ভাগ জলের সাথে একভাগ ওষুধের মূল আরক মিশিয়েও লোশন প্রস্তুত করা যাবে।

এই লোশন কোথাও কেটে গেলে, কাটা ছেঁড়া বা ক্ষেতলে যাওয়া ক্ষতে, ঘর্ষণজনিত ক্ষতে, ফোঁড়া, কার্বঙ্কল, পরিষ্কার, অপরিষ্কার বা দূষিত সকল প্রকার ক্ষতে ক্যালেন্ডুলার লোশন উপযোগী। আর দূষিত সকল প্রকার ক্ষতেই হাইপেরিকাম লোশন সর্বপ্রথম ব্যবহার করতে হবে।

গভীর জাতীয় ক্ষতে পিচকারী দ্বারা লোশন প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

ক্যালেন্ডুলা লোশনে তুলা বা বস্ত্র খন্ড ভিজিয়ে তা ক্ষতের উপর রেখে শুকনো কাপড়ের ব্যান্ডেজ দ্বারা বেঁধে দিতে হবে। দিনে মাত্র একবার এরকম ভাবে ব্যান্ডেজ দিলেও ক্ষত দ্রুত আরোগ্য হয়ে যাবে। সম্ভব হলে দিনে দুবার এভাবে লোশন প্রয়োগ করতে পারলে তা অধিক কার্যকরী হবে।

যেকোনো প্রকার দূষিত ক্ষত এমনকি পচনশীল ক্ষত আরোগ্য করতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ হোমিওপ্যাথিতে আছে সেটি হল একিনেেশিয়া। এটিও মাদার টিংচার ফর্মে লোশন প্রস্তুত করে প্রয়োগ করতে হয়। 

বাহ্যিকভাবে প্রয়োগের সাথে সাথে এই সকল ঔষধ অভ্যন্তরীণ প্রয়োগে রোগ আরো দ্রুত আরোগ্য হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আইটিচহেলথ এর নীতিমালা মেনে তবেই মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। প্রত্যেকটি মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে যাচাই করা হয়।

comment url