যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ, কারন ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

ভূমিকাঃ আজকের আলোচনাতে আমি যক্ষা বা টিবি রোগের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব। যক্ষা(TB) রোগের বর্ণনা, যক্ষা রোগের লক্ষণ ও কারণ, প্যাথলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন, যক্ষা রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা এবং যক্ষা রোগীর খাবার তালিকা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব।

যক্ষা রোগের বর্ণনাঃ

মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস(Mycobacterium tuberculosis) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে যক্ষা রোগ। এটি একটি প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ। যক্ষা রোগের ব্যাকটেরিয়া ফুসফুস আক্রমণ করে থাকে। এছাড়াও যক্ষা শরীরে যে কোন অঙ্গেই হতে পারে। তবে সাধারণত হৃৎপিণ্ড, থাইরয়েড গ্রন্থি ও অগ্নাশয়ে যক্ষা খুব একটা দেখা যায় না। “রাজক্ষয়” শব্দটি থেকে যক্ষা শব্দটি এসেছে।  এটিকে ক্ষয় রোগ বলা হচ্ছে এই কারণে যে যক্ষা রোগী ক্রমাগ জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়ে ও শরীর শুকিয়ে যায়।

ফুসফুসের যক্ষা অনেক সময় অন্য অঙ্গতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে একই সাথে ফুসফুসে এবং অন্যান্য অঙ্গে যক্ষা রোগ রোগীতে বর্তমান থাকতে দেখা যায়।

যক্ষা রোগের লক্ষণঃ

বিভিন্ন অঙ্গে যক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম লক্ষণ দেখা যায় তবে ফুসফুসে যক্ষার ক্ষেত্রে রোগীর সাধারণত কাশি, বুকে ব্যথা, কাশির সঙ্গে কফ বা রক্ত যাওয়া, শরীর শুকিয়ে যাওয়া এ জাতীয় লক্ষণ সমূহ থাকে। কাশি সাধারণত তিন সপ্তাহের অধিক সময়কাল যাবত থাকতে দেখা যায়। তার সাথে নিয়মিতভাবে জ্বর আসতে দেখা যায়। রোগীর ওজন দ্রুত কমে যেতে থাকে। বুকে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা ইত্যাদি নানাবিধ লক্ষণ রোগীতে প্রকাশিত হয়ে থাকে। 

যক্ষা রোগীর ফুসফুস

ফুসফুসে যক্ষার আরো কিছু লক্ষণ 

১) তিন সপ্তাহের অধিক সময়কাল যাবত একনাগাড়ে কাশি। 

২) প্রতিদিন নিয়ম করে একটা সময় (বিশেষত বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে) জ্বর আসা। জ্বরের তাপমাত্রা খুব অতিরিক্ত হয় না বটে তবে ভীষণ দুর্বলতা ও ক্লান্তি ভাব থাকে রোগীর। 

৩) কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা বা রক্ত এসব যেতে পারে।

৪) শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পায় ও রোগী খুব শুকিয়ে যায়। 

৫) খাওয়া দাওয়ায় রোগীর রুচি থাকে না। অনেক সময় রোগীর খাদ্যদ্রব্যের গন্ধের অনুভব কমে যায়।

৬) কখনো কখনো রোগীর ভীষণ চোটে বুকে ব্যথা থাকতে পারে। 

৭) রোগীর অনেক সময় রাত্রিতে ঘুমের ভেতর প্রচণ্ড পরিমাণে ঘাম হয়।

যক্ষা রোগের কারণঃ

যক্ষা কিভাবে ছাড়াই এই ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। যক্ষা একটি বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ। অর্থাৎ যক্ষা রোগের জীবাণু হাঁচি, কাশি, থুতু ইত্যাদি থেকে বাতাসের মাধ্যমে একজন থেকে অন্য জনের সংক্রামিত হয়। যক্ষা রোগের জীবাণু বাতাসে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল, ধূমপায়ী ব্যাক্তি, ডায়াবেটিস ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে যক্ষা রোগটি হওয়ার।

যক্ষা রোগের পরীক্ষার নামঃ

যক্ষা রোগটি নির্ণয় করতে হলে সাধারণত যে সকল প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার প্রয়োজন হয় সেগুলো হলঃ 

১) ত্বকের পরীক্ষা 

২) রক্ত পরীক্ষা 

৩) কফ পরীক্ষা 

৪) বুকের এক্সরে  

যক্ষা রোগটি নির্ণয় করতে রক্ত পরীক্ষা হিসেবে interferon Gamma Release(IGRA) করার প্রয়োজন হয়। 

কফ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ভাবে পরীক্ষা করা হয়। 

১) Sputum smear

২) Sputum culture 

Sputum smear দ্বারা দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায় তবে এটি সব সময় একুরেট হিসাব দিতে পারেনা।

 কিন্তু Sputum culture দ্বারা একটু সময় অধিক লাগলেও এটি নিশ্চিত ভাবে ফলাফল প্রদান করে। 

বুকের এক্সরে দ্বারা ফুসফুসের আকৃতিগত কোন অসুবিধা আছে কিনা পর্যবেক্ষণ করা যায়। এছাড়াও অ্যাডভান্স পরীক্ষা হিসাবে Bronchoscopy, Biopsy Molecular test ইত্যাদি টেস্টগুলো রোগের তীব্রতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী করা যেতে পারে। 

যক্ষা রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

অন্যান্য রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মতই যক্ষা রোগীতেও রোগীর লক্ষণ সাদৃশ্যে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগীর এবং রোগের সামগ্রিক লক্ষণ সামগ্রই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনের পথপ্রদর্শক। লক্ষণ সাদৃশ্য থাকলে সাধারণত নিচের ঔষধ গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে- 

Arsenic alba, Bryonia, Apis mel, Rhus tox, Rumex, Tuberculinam, Phosphorus ইত্যাদি।

এছাড়াও আরো যে কোন ঔষধই নির্বাচিত হতে পারে রোগীর জন্য যদি রোগীতে ওই ঔষধের লক্ষণ পাওয়া যায়। যে কোন প্রকার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

যক্ষা রোগীর খাবার তালিকাঃ

যক্ষা রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়ে যক্ষা থেকে সেরে ওঠার জন্য অবশ্যই সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে। রোগীকে এখানে যক্ষা রোগের একটি খাবার তালিকা দেয়া হলো।

শাকসবজিঃ রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি খেতে হবে। লাউ শাক, পালং শাক, গাজর, শসা, ইত্যাদি সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। বিভিন্ন শাক জাতীয় খাবার খেতে হবে। 

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারঃ মাংস খেলে চর্বিহীন মাংস খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়াও মাছ, ডিম ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এখানে লক্ষনীয় যে, যক্ষা রোগীর ক্ষেত্রে রেডমিট যেমন গরুর মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস এসব খাদ্য অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। 

ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারঃ ভিটামিন এ, সি এবং ই এর প্রাচুর্য রয়েছে এরকম খাবার রোগীকে খেতে দেওয়া উচিত। যেমন লেবু, পেয়ারা, টমেটো, গাজর, আম, বীজ, আমলকি, বাদাম ইত্যাদি। 

দুগ্ধজাত খাবারঃ রোগীকে বিভিন্ন প্রকারের দুগ্ধজাত খাবার খেতে দিতে হবে। এছাড়াও প্রবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্য ‘দই’ রোগীকে খেতে দেয়া যেতে পারে।

জিংক সমৃদ্ধ খাবারঃ জিংক এর যোগান পাওয়া যাবে এমন খাবার রোগীকে খেতে দিতে হবে। তাতে রোগীর শরীরে জিংকের ঘাটতি পূরণ হবে ফলে রোগী দ্রুত যক্ষা থেকে সেরে উঠবে। কুমড়ার বীজ, চিয়াসিড ইত্যাদি রোগীকে খেতে দিলে রবির শরীরে জিংকের অভাব পূরণ হবে।

যে সকল খাবার যক্ষা রোগীকে খেতে দেওয়া যাবে নাঃ বিভিন্ন ফাস্টফুড, তৈলাক্ত খাবার এসব যক্ষা রোগীকে সর্বতভাবে বর্জন করতে হবে। কফি, চা, এনার্জি ড্রিংক ইত্যাদি ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। ধুম্রসেবন বা মধ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে এ সময় পরিহার করতে হবে।

যক্ষা রোগ নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বঃ

এখন আমরা যক্ষা রোগ বিষয়ক প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করব। যক্ষা রোগ বিষয়ক যেকোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এ উল্লেখ করুন। আমরা যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

প্রশ্নঃ যক্ষা রোগের জীবাণুর নাম কি?

উত্তরঃ যক্ষা রোগের জীবাণুর নাম হল মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস। এই জীবাণু বায়ুর মাধ্যম দিয়ে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রামিত হয়ে থাকে। জীবাণু বায়ুর ভিতরে বেশ কয়েক ঘন্টা জীবিত থাকতে পারে। 

প্রশ্নঃ যক্ষা কি ছোঁয়াচে রোগ?

উত্তরঃ না যক্ষা রোগ কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং যক্ষা রোগীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটি কখনো স্পর্শের মাধ্যমে খাবার পানি ভাগ করে খাওয়ার মাধ্যমে সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে না। 

প্রশ্নঃ যক্ষা কত প্রকার?

উত্তরঃ যক্ষা রোগের দুইটি অবস্থা পাওয়া যায়। একটি হলো প্রিটিউবারকুলার স্টেজ বা latent TB আরেকটি হলো টিউবারকুলোসিস বা যক্ষাবস্থা। ডায়নামিক স্টেজ এ যক্ষা রোগের লক্ষণ রোগীর শরীরে অনুভব হলেও প্যাথলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনে যক্ষা রোগের জীবাণুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে না। 

প্রশ্নঃ যক্ষা হলে কি সহবাস করা যায়?

উত্তরঃ যক্ষা রোগাবস্থায় একজন ব্যক্তির সহবাস থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। আর যদি নিতান্তই সহবাস করতে হয় তবে অবশ্যই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে করতে হবে। এক্ষেত্রে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে তা করতে হবে। এছাড়াও বিবেচনা রাখতে হবে যদি সঙ্গিনীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, অথবা সঙ্গিনী গর্ভবতী হয় সে ক্ষেত্রে সহবাস এড়িয়ে চলতে হবে।

প্রশ্নঃ যক্ষা কি ভাইরাস জনিত রোগ?

উত্তরঃ না যক্ষ্মা কোন ভাইরাসজনিত রোগ নয়। এটি মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত একটি রোগ। যক্ষা রোগটি বায়ুবাহিত এবং সংক্রামক প্রকৃতির রোগ। রোগটি যথাক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি ও থুতুর মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ুর মাধ্যম দিয়ে অন্যরা সংক্রমিত হয়।

প্রশ্নঃ যক্ষা রোগের টিকার নাম কি?

উত্তরঃ যক্ষা রোগের টিকার নাম বিসিজি। শিশুর জন্মের পরপরই সাধারণত বিসিজি টিকা দেয়া হয়ে থাকে। এটি সকল ধরনের যক্ষাকে প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে এটি মেনিনজাইটিস এবং মেরুদন্ডের যক্ষাকে প্রতিরোধ করতে খুবই কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু(WHO) এর মতামত অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত টিকা গুলির ভিতর অন্যতম বিসিজি টিকা। প্রতিবছর অন্তত ১০০ মিলিয়ন এর অধিক শিশুকে এই টিকা দেওয়া হয়।

বিসিজি টিকা সাধারণত নিরাপদ তবে কিছু ক্ষেত্রে সামান্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। 

প্রশ্নঃ যক্ষা রোগের চিকিৎসা কোথায় হয়?

উত্তরঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে যক্ষা রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। জাতীয় যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যক্ষার যথার্থ চিকিৎসা পাওয়া যায়।

এছাড়াও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিক, বিভিন্ন এনজিও যেমন ব্রাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, আইসিডিডিআর সহ অনেক এনজিও প্রতিষ্ঠান তাদের সেবামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ এলাকায় যক্ষ্মা রোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় সহায়তা দিয়ে থাকে।

আরো পড়ুনঃ
জ্বরের প্রকারভেদ, ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসা

ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
১৮.০৫.২০২৪

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
1 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • নামহীন
    নামহীন ২৪ জুন, ২০২৪ এ ১০:৩১ PM

    খুব তথ্যবহুল ভাবে লেখার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগের নীতিমালা মেনে তবেই মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। প্রত্যেকটি মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে যাচাই করা হয়।

comment url