যোগমুদ্রার উপকারিতা| জনপ্রিয় ১০ টি যোগ মুদ্রার নাম

ভূমিকাঃ যোগমুদ্রা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং আধ্যাত্মিক প্রগতির ভেতর সমন্বয়ে এনে জীবনকে অর্থবাহ করে তুলতে সাহায্য করে। এই মুদ্রার প্রকৃত অনুশীলনকারী নিশ্চিতরূপেই উপকার প্রাপ্ত হয়। আজকের আলোচনাতে যোগমুদ্রা কি? এটির উৎপত্তি? প্রকারভেদ? উপকারিতা? ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করব। এর সাথে সাথে সর্বাধিক জনপ্রিয় ১০ টি মুদ্রার নাম ও উপকারিতা সম্পর্কে বলব।

যোগ মুদ্রা কি?

যোগমুদ্রা হল এমন একটি বিশেষ পদ্ধতি যেখানে হাতের আঙ্গুলের ভঙ্গিমা, শরীরের ভঙ্গি এবং মুখের অবিব্যক্তির কিছু কৌশলের অনুশীলন দ্বারা শরীরের মধ্যে শক্তির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ এবং মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করা হয়। দেহ ও মনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হাতের আঙ্গুলের নির্দিষ্ট অবস্থানের ব্যবহারকে যোগোমুদ্রা বলে। নিয়মিতভাবে এই যোগমুদ্রার অনুশীলন করলে তা মানসিক একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, মনকে অনর্থক চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। জীবনশক্তিকে শক্তিশালী করে ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

Five fingers name in english

যোগমুদ্রার উৎপত্তি? 

যোগাসনের সাথে সম্পৃক্ত এই যোগমুদ্রা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি পুরাতন যোগ ব্যায়াম। সনাতন হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এর সম্পর্ক পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ঋষি পতঞ্জলি রচিত যোগসূত্রে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। শরীর, মন এবং আত্মার ভারসাম্য রক্ষা করে মনকে কেন্দ্রীভূত করা বা মনকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই যোগমুদ্রার অনুশীলন করা হয়।

যোগমুদ্রার প্রকারভেদঃ

যুগ মুদ্রা যোগাসন এবং প্রাণায়াম মৌলিক বিচারে প্রত্যেকটি অপরটি থেকে ভিন্ন তবে ব্যবহারিকভাবে এর একটি উন্নতির সাথে যুক্ত হয়ে সুসম্পন্ন হয় মুদ্রা বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে যেমন হাতের মুদ্রা শরীরের মুদ্রা ও মুখের মুদ্রা।

যোগমুদ্রা গুলো বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-

আসন– বসার ভঙ্গি।

প্রাণায়াম– শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করা।

মুদ্রা-হাতের আঙ্গুলের ভঙ্গিমা।

বন্ধ-শরীরের বিভিন্ন অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

ক্রিয়া-শারীরিক ক্রিয়াকলাপ।

যোগ মুদ্রার উপকারিতাঃ

মুদ্রার নিয়মিত অনুশীলনে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অর্জিত হয়। সাথে সাথে আধ্যাত্মিক প্রগতি ও হয়ে থাকে। যোগমুদ্রার উপকারিতা তুলে ধরা হলো এখানে।

১) মানসিক একাগ্রতা বজায় থাকে। মনকে কেন্দ্রীভূত করে। মানসিক স্থিরতা আনে। মানসিক দুশ্চিন্তা, চাপ, উদ্বেগ এগুলো কমায়।

২) শারীরিক সুস্থতা লাভ হয়। নিয়মিত বিভিন্ন মুদ্রার অনুশীলন মানসিক উন্নতির সাথে সাথে শারীরিক নানাবিধ উপকার করে থাকে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ভারসাম্য রক্ষা করে। শরীরের ভেতর শক্তির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রন করে।

৩) যেহেতু মনকে একাগ্র করে এবং শরীরকে সুস্থ করে এবং সর্ব মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে ফলে আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

আরো পড়ুনঃ
সুস্থ জীবন গঠনে আয়ুর্বেদ| আদর্শ জীবনাচরণ| প্রথম পর্ব

যোগমুদ্রার ব্যবহারিক তত্ত্বঃ

পাঁচটি মৌলিক পদার্থ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম দ্বারা আমাদের শরীর গঠিত। প্রকৃতিতেও এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান বিরাজমান। এই পাঁচটি উপাদানকে একত্রে পঞ্চমহাভূত বলে। আমাদের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল প্রত্যেকটা মৌলিক উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করে।

১) অগ্নির প্রতিনিধিত্ব করে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল(Thumb)।
২) তর্জনী(Index) আঙ্গুল বায়ুর প্রতিনিধিত্ব করে।
৩) মধ্যমা(Middle finger) আঙ্গুলটি প্রতিনিধিত্ব করে আকাশ এর।
৪) অনামিকা(Ring finger) প্রতিনিধিত্ব করে মাটির।
৫) কনিষ্ঠা(Little finger) আঙ্গুল জলের প্রতিনিধিত্ব করে।

মুদ্রার অনুশীলনের সময় আঙ্গুলের অগ্রভাগের Nerve ending এর মধ্যে একটা কানেকশন তৈরি হয়। নিয়মিত মুদ্রার অনুশীলন শরীরের প্রাণশক্তিকে প্রভাবিত করে।

জনপ্রিয় ১০ টি যোগমুদ্রাঃ

সুপ্রাচীন এই যোগ মুদ্রার সঠিক সংখ্যা বলা না গেলেও ব্যাপকভাবে পরিচিত হাতের বিভিন্ন মুদ্রার সংখ্যা প্রায় ১০০ টি অধিক হবে। জানা যায় অন্তত 108 টির মত মুদ্রা অধিক জনপ্রিয়। এর ভেতর থেকে বিশেষ বিশেষ ভাবে জনপ্রিয় এবং অনুশীলন করা হয় এরকম দশটি মুদ্রার উল্লেখ করছি এখানে।

১) জ্ঞানমুদ্রাঃ এটির অনুশীলনে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। মানসিক একাগ্রতা বাড়ে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা কমে।

২) বায়ু মুদ্রাঃ এই মুদ্রার অনুশীলনে ডাইজেস্টিভ সিস্টেম এর উপরে সুন্দর ক্রিয়া হয়। হজম শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং এসিডিটি, গ্যাস, অম্বল ইত্যাদির সমস্যা দূরীভূত হয়। পেটের পেশি শক্তিশালী হতে থাকে।

৩) সূর্যমুদ্রাঃ থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতার ভারসাম্য রক্ষা করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। মানসিক দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও হতাশা কমাতে সাহায্য করে।

৪) মৃত্যুঞ্জয় মুদ্রাঃ এই মুদ্রা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীর ও মনের শক্তি বাড়ায়। মানসিক ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর করতে সহায়তা করে।

৫) শূন্য মুদ্রাঃ শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উপর ইতিবাচক ক্রিয়া করে তাদের নানাবিধ সমস্যা দূর করে। শ্রবণ শক্তি বৃদ্ধি করে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় ও মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে।

৬) হৃদয় মুদ্রাঃ হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতাকে সুসংহত রাখে এবং হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা কে উন্নত করে। শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে মানসিক প্রশান্তি আনে।

৭) পৃথিবী মুদ্রাঃ মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি করে এবং মনকে শান্ত রাখে। আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।

৮) বরদ মুদ্রাঃ মনকে ইতিবাচক ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট করে। মনে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি পায় ফলে মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মানসিক ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর হয় এই মুদ্রার নিয়মিত অনুশীলনে।

৯) তিলক মুদ্রাঃ মানসিক একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। স্মৃতিশক্তি বাড়ে এবং অস্থিরতা কমে।

১০) আপান মুদ্রাঃ শরীরে জমে থাকা বিভিন্ন দূষিত টক্সিন পদার্থকে বের হতে সাহায্য করে এই মুদ্রার নিয়মিত অনুশীলন। হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। পেটের বেশি শক্তিশালী হয়।

এই মুদ্রা গুলি অধিক জনপ্রিয় এই কারণে যে, এদের অনুশীলন তুলনামূলক সহজ এবং এগুলি নিয়মিত অনুশীলনের দ্বারা অধিক উপকার পাওয়া যায়। মুদ্রার অনুশীলনে যারা নতুন এবং অভিজ্ঞ পুরাতন অনুশীলনকারী উভয়ের জন্যই এই মুদ্রাগুলি উপযোগী।

এছাড়াও আরো কিছু জনপ্রিয় যোগমুদ্রার নাম হলোঃ

অঙ্গুষ্ঠ মুদ্রা, মহা মুদ্রা, পদ্ম মুদ্রা, মৎস্য মুদ্রা, বজ্র মুদ্রা, চন্দ্র নমস্কার মুদ্রা, হস্ত মুদ্রা, গরুড় মুদ্রা, কুর্মা মুদ্রা, নাভি মুদ্রা, শঙ্খ মুদ্রা, মুখ মুদ্রা, বিশ্ব মুদ্রা, সূর্য নমস্কার মুদ্রা, মহাবিশ্ব মুদ্রা, লিঙ্গ মুদ্রা, ত্রিকোণ মুদ্রা, মহা মৃত্যুঞ্জয় মুদ্রা, শক্তি মুদ্রা, আপান মুদ্রা, আদি মুদ্রা, বিষ্ণু মুদ্রা, গ্রন্থিত মুদ্রা, ভৈরব মুদ্রা, ইয়োনি মুদ্রা, চিন মুদ্রা, পূর্ণ মুদ্রা বা ব্রহ্ম মুদ্রা, হাকিনী মুদ্রা, পৃথ্বী মুদ্রা, অঞ্জলি মুদ্রা ইত্যাদি।

তবে অনুশীলনের জন্য মুদ্রা নির্বাচনে শারীরিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতার মান বিবেচনা করা আবশ্যক। উপযুক্ত মুদ্রা নির্ধারণে সহায়তার জন্য একজন অভিজ্ঞ অনুশীলনকারী অথবা শিক্ষকের সহযোগিতা গ্রহণ করা উচিত। অনলাইনে বিভিন্ন রিসোর্স, ইউটিউব ইত্যাদি থেকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে।

যোগ মুদ্রা অনুশীলনের কৌশলঃ

মুদ্রা অনুশীলনের পূর্বে সচেতন ভাবে কিছু প্রস্তুতি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিচে এই বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

মুদ্রা অনুশীলনের পূর্ব প্রস্তুতিঃ মুদ্রা অনুশীলনের পরিবেশ অবশ্যই শান্ত ও আরামদায়ক হতে হবে। অনুশীলনের জন্য পরিচ্ছন্ন ও নির্মল পরিবেশ বাছাই করুন।

পোশাকঃ আরামদায়ক পোশাক এমনভাবে পরিধান করুন যেন নড়াচড়া করতে অসুবিধা না হয়। স্বল্প পোশাক পরিধান করুন মুদ্রা অনুশীলনের সময়।

সময়ঃ সাধারণত দিনের বা রাত্রের যেকোনো সময়ই মুদ্রার অনুশীলন করা যায়। তবে সকালে যোগের অনুশীলন দ্বারা দিনের শুরু করাটা সর্বোত্তম। খালি পেটে যোগানুশীলন করা ভালো। তবে আহারের পরে মুদ্রার অনুশীলন করতে হলে অন্তত আহারে দুই থেকে তিন ঘন্টা পরে করা যেতে পারে। অসুস্থ থাকলে বা আহারের পর পর অথবা গর্ভবতী অবস্থায় যোগের অনুশীলন করা উচিত নয়।

মুদ্রা অনুশীলনকালীন প্রস্তুতিঃ 

মনোযোগঃ অনুশীলনের সময় মনকে একাগ্র রাখুন এবং বর্তমান সময়ে মনোযোগী হোন। শ্বাস-প্রশ্বাসঃ শ্বাস প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিন। মুদ্রা অনুশীলনের সময় প্রত্যেক মুদ্রার সঠিক ভঙ্গির অনুসরণ করতে হবে। 

সময়ঃ প্রত্যেকটি মুদ্রা নির্দিষ্ট সময় নিয়ে অভ্যাস করতে হবে। 

বিশ্রামঃ প্রত্যেকটা মুদ্রার অনুশীলনের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করুন।

মুদ্রা অনুশীলনের সতর্কতাঃ

কোন মুদ্রা অনুশীলনের সময়ে অসস্তি বা অসুস্থতা বোধ করলে অনুশীলন বন্ধ করুন। নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আপনার কোন প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। মুদ্রা অনুশীলনে সচেতন না হলে আমরা কখনই যোগমুদ্রার পূর্ণ সুবিধা পাবনা।

মুদ্রা অনুশীলনে উপকারিতা বৃদ্ধির টিপসঃ

কিভাবে মুদ্রার অনুশীলন করে সর্বোচ্চ উপকারিতা পাবেন তার কিছু টিপস এখানে উল্লেখ করলাম।

নিয়মিত অনুশীলনঃ একটি সময় নির্দিষ্ট করে নিয়ম করে প্রতিদিন অনুশীলন চালিয়ে যান। প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট অথবা ৩০ মিনিট এরকম কোন সময় ধরে মুদ্রার অনুশীলন করুন।

ধৈর্য ধারণঃ মুদ্রা অনুশীলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা থেকেই সফলতা লাভ করা যেতে পারে। তাই অবশ্যই ধৈর্য ধরে অনুশীলন চালিয়ে যান।

অনুপ্রেরণাঃ সমমনা কোন ব্যক্তি, সঙ্গী বা এরকম কোন সংগঠন, গ্রুপ বা ফোরামে যোগদান করলে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে যোগদান করা যেতে পারে।

আরো পড়ুনঃ
যোগাসন এর অনুশীলন করুন জীবন বদলাবেই

এই লেখাটি ইংরেজীতে পড়ুনঃ
Yoga mudra benefits. Name of 10 popular yoga mudra

ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
০২.০৪.২০২৪

——————————

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগের নীতিমালা মেনে তবেই মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। প্রত্যেকটি মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে যাচাই করা হয়।

comment url