ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির বাস্তবিক অর্থ। -প্রথম পর্ব।

ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির বাস্তবিক অর্থঃ

আমরা অনেকেই ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কথা বলি। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় এটি সমর্থন করা বা না করা নিয়ে তর্ক বিতর্কও তৈরি হয়। আর এটিকে কেন্দ্র করে হোমিওপ্যাথিতে অনেক মতবাদ, মেথড ইত্যাদিও তৈরি হয়েছে।
এইক্ষেত্রে আমার বক্তব্যঃ
হোমিওপ্যাথিতে নিঃসন্দেহে ক্লাসিক্যাল চিকিৎসার দাম সর্বোচ্চ। Constitutional Treatment এর প্রয়োগ ব্যতিরেকে Therapeutic Way তে সব সময় কঠিন ও জটিল রোগের ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু আমরা অনেকেই এসব বিষয়ে ভেবে দেখেছি কি?
ক্লাসিক্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্র আছে। লক্ষণ সাদৃশ্যে ঔষধ নির্বাচন করার যেমন ক্ষেত্র আছে তেমনি ঔষধ বিহীন শুধুমাত্র পরামর্শ দ্বারাও চিকিৎসা করার ক্ষেত্র আছে। আবার কিছু সময় মাদার টিংচার ব্যবহার করারও ক্ষেত্র আছে। অনুপূরক ও পরিপূরক ঔষধ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আছে। পিওর হোমিওপ্যাথির নাম করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও বায়োকেমিক এর সুপরিচিত, সুপরীক্ষিত ও কার্যকরী ঔষধ গুলোকে এড়িয়ে চলব সেটিও যুক্তিসংগত নয়। শুধু একটিমাত্র ঔষধ ব্যবহার করে সব সময় রোগীকে আরোগ্য করা সম্ভব হয় না(তবে একই সময়ে একাধিক হোমিওপ্যাথিক শক্তিকৃত ঔষধ ব্যবহৃত হয়না)।
Dr. Dipankar Mondal


কেননা হোমিওপ্যাথি তো কোনো নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা করে না(Homeopathy treats the patient not the disease). রোগীর Vital Force/Vital Principal এর সাদৃশ্য অনুযায়ী Similimum ঔষধ দ্বারা রোগীর জীবনী শক্তির মাধ্যমে রোগীকে সর্বাঙ্গীনভাবে আরোগ্যের চেষ্টা করা হয়।
যদি কখনো Psora মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তো দেখা যাচ্ছে তখন Sycotic Miasm ব্যাকগ্রাউন্ডে আছে। আবার কখনও Syphilitic Miasm এর সঙ্গে Psora Miasm জট পাকিয়ে Tubercular পরিস্থিতির উদ্ভব করছে। এসব ক্ষেত্রে অগ্রভাগে অবস্থিত Miasm টির চিকিৎসা শেষে Second Layer এ যে Miasm অবস্থিত সেটিকে উদ্দেশ্য করে ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে মায়াজমের ভিন্ন ভিন্ন ধাপে ভিন্ন ভিন্ন Similimum শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়।
মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান বলেছেন যে, “চিকিৎসা শেষে রোগীর ধাতুগত লক্ষণের সাদৃশ্য অনুযায়ী একটি অ্যান্টিসোরিক ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা শেষ করতে হবে”।
মায়াজম এর বিশ্লেষণ পূর্বক, সর্বাঙ্গীণ লক্ষণ সাদৃশ্য বিবেচনায় একই সময়ে একক ঔষধ ব্যবহার করে, সূক্ষ্ম শক্তিতে এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহার করে চিকিৎসা করার পদ্ধতিকে ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি বলে।
তবে সেক্ষেত্রেও কথা আছে-
ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি বলতে সামগ্রিক হোমিওপ্যাথিকেই বুঝিয়ে থাকে। কোন আংশিক ধারণা বা পদ্ধতি নয়ঃ
কোন ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে আসলো। কিন্তু তার সেই রোগটি Conservative চিকিৎসা পদ্ধতিতে আরোগ্য হওয়ার নয় বরং True Surgical কেস। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে কোন ঔষধ না দিয়ে, অযথা কালক্ষেপণ না করে বরং দ্রুত সার্জারির পরামর্শ দেওয়াটাও ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি।
অর্থাৎ শুধু একক ঔষধ ব্যবহার করলেই ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি হয়না সেটা! পরিস্থিতির বিচারে, রোগীর রোগ আরোগ্যের উদ্দেশ্যে, যুক্তিসংগত কারণে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই প্রকৃত ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি।
আবার রোগীর কিছু Symptoms নিয়ে Computerized Repertory এর মাধ্যমে ঔষধ নির্বাচন করে, অন্ধভাবে রেপার্টরির অনুসরণ করাও কখনোই যুক্তিযুক্ত নয় ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিও নয়।
অর্থাৎ এসব বলে আমি বোঝাতে চাইছি যে আমাদের অনুভব করা উচিত, উপলব্ধি করা উচিত যে, ঠিক কখন কোন পরিস্থিতিতে আমাদের ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার দরকার।
রোগী আরোগ্যে সর্বদাই একই পন্থা কার্যকারী হয় না । রোগীকে আরোগ্য করতে হয় নানাভাবে। যুক্তি দিয়ে, বল দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, একক ঔষধ দিয়ে, Food Supplement এর কার্যকারিতা বুঝিয়ে, আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনা জানিয়ে, ঔষধ দিয়ে এমনকি ঔষধ না দিয়েও রোগীকে আরোগ্য করা যায়।
হ্যাঁ সত্যই, কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে ঔষধ না দিয়েও আরোগ্য করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরামর্শ দ্বারা, জীবনযাপনের বদল হলেই অনেক রোগ আরোগ্য হয়ে যায়।
ঔষধ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র জীবনযাপনের বদল দ্বারাই যদি রোগারোগ্য হতে পারে(তবে এটিও ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি)-
তাহলে এক্ষেত্রেঃ
১) এখানে তো কোনো একক ঔষধ ব্যবহৃত হলো না!
২) সূক্ষ্মমাত্রায় ঔষধ দেওয়ার কথা আসলো না!
৩) স্বল্প মাত্রায় ঔষধ দেওয়া লাগল না!
৪) Decimal, Centesimal, 50 millesimal এসব ঔষধের কথা আসলো না।
বায়োকেমিক, পেটেন্ট, মাদার টিংচার এর কথা বাদই দিলাম।
তার কারণ রোগীর রোগটি True Chronic Disease নয়। এটি False Disease. রোগটি Chronic Miasm থেকে উদ্ভূত নয়। এক্ষেত্রে রোগীকে যতই মায়াজমেটিক চিকিৎসা করা হোক না কেন, ক্লাসিক্যাল চিকিৎসা করা হোক না কেন, রোগীর জীবন যাপন, অভ্যাসগত আচরণ এসবের পরিবর্তন না হলে রোগারোগ্য হবে না।
তাহলে মূলকথা হচ্ছে “রোগীকে সর্বাঙ্গীনভাবে সুস্থ করতে হলে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যা যা প্রয়োজন তাইই একটা চিকিৎসা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য”।
আর এই উদ্দেশ্য পালন করতে গিয়ে কখনো রোগীকে ঔষধ দেওয়া লাগবে, কখনো ঔষধ দেওয়া লাগবে না, কখনো শুধু পরামর্শই যথেষ্ট, আবার কখনো আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার উপর বেশি নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে  এই পরামর্শ বা ব্যবস্থাপনাটাও চিকিৎসার অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য।
কেননা যে কোন রোগ আরোগ্য একমাত্র তখনই সম্ভব যখন রোগটা আরোগ্যের পর্যায়ে বা Curable Stage এ থাকে। Incurable Disease কখনোই আরোগ্য হয় না। কোনো প্যাথির চিকিৎসাতেই(Homeopathy, Naturopathy, Allopathy) তা আরোগ্য হয় না।
অর্থাৎ-
——
কোন রোগীর রোগ আরোগ্যে প্রথমত বিবেচনায় রাখতে হবে এটা যে, রোগটি True Disease নাকি False Disease অথবা True Surgical Case?
আজকালকার দিনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক রোগই False Disease বা জীবনযাপনের অনিয়ম বা পারিপার্শ্বিক বিরূপ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট রোগ। এখানে True Disease বলতে Miasmatic রোগগুলোকে বোঝানো হচ্ছে(প্রত্যেকটি রোগকেই শরীরের ভেতর কমবেশি স্থান দেয় Miasm নামক এক প্রকার সূক্ষ্ম অজড় শক্তি)।
দীর্ঘদিন আহার বিহারে অমিতাচারের দরুন যে রোগ সৃষ্টি হয় এসব রোগের ভেতর কিছু রোগ কখনোই কোনো ঔষধের দ্বারা আরোগ্য হওয়ার নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত রোগী অমিতাচার জীবনযাপন পরিত্যাগ করে আবার কিছুদিন নিয়মিত জীবন যাপন করে। শুধু ঔষধ নির্ভর   চিকিৎসা এখানে প্রযোজ্য নয় কেননা এটি মায়াজম সৃষ্ট রোগ নয়। এক্ষেত্রে ঔষধ সহায়ক হিসেবে রোগারোগ্যে রোগীকে কিছুটা সাহায্য করে মাত্র। বাকিটা রোগীর ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহারিক জীবনযাপনে শৃঙ্খলা অনুযায়ী ঘটে থাকে।
যেমন গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা। এই গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা সাধারণত আহার বিহারে অনিয়ম, অমিতাচার এর কারণেই হয়ে থাকে। আর প্রকৃত প্রস্তাবে এই গ্যাস অম্বলের কোনো চিকিৎসা নেই। না তো হোমিওপ্যাথিতে না তো এলোপ্যাথিতে। যতক্ষণ না রোগী নিয়মিত জীবনযাপন, বিশেষ করে শৃঙ্খলিত খাদ্যাভাস তৈরি না করে। তুলনামূলকভাবে যদিও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকরী। তবুও রোগীকে অবশ্যই জীবনাচরণের অমিতচারিতা পরিবর্তনের মানসিকতা রাখতে হবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে তার প্রয়োগ করতে হবে। সঙ্গে সহায়ক হিসেবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করলে এই জাতীয় রোগ থেকে আরোগ্য সম্ভব। কিন্তু জীবনযাপনের পরিবর্তন ব্যতিরেকে শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন দ্বারা তেমন কোনো সুফল আশা করা যায় না। তবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধে কিছু ক্ষেত্রে রোগটি হয়তো কিছুদিনের জন্য কম থাকে বা কিছু উপশম হয় কিন্তু আরোগ্য হয় না যতক্ষণ না নিয়মিত জীবনযাপনের সাথে ঔষধ সেবন করা হয়।
আবার ধরা যাক রিউম্যাটিজম বা অস্টিওআর্থারাইটিস। এগুলোও একই ধরনের রোগ যা দীর্ঘদিন যাবৎ নির্বিচারে কোলেস্টরেল সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের কারণে রক্তে ইউরিক এসিড বৃদ্ধি ফলে হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে ঔষধ সেবনের সাথে সাথে কিছু আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর রাখতে হবে। রোগ সম্বন্ধীয় কিছু সাধারণ শরীরচর্চার অভ্যাস করতে হবে।
দীর্ঘদিন অনিদ্রা বসত যে শারীরিক দুর্বলতার সৃষ্টি তাও কখনো কোন ঔষধেই যাওয়ার নয় যতক্ষণ না সে পুনরায় নিদ্রা দ্বারা শরীরের ক্ষয় পূরণ করে। সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ঔষধ সেবন করতে হবে। কিন্তু জীবনযাপনের পরিবর্তন ব্যতিরেকে, শুধুমাত্র ঔষধ সেবন দ্বারা এসব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে রোগজনিত অসুস্থতা কে দূরীভূত করা যায় না।
অর্থাৎ যে সমস্ত রোগের Causative Factor আছে সেগুলোর Causative Factor দূর করার আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র ঔষধ দ্বারা রোগারোগ্য কোনভাবেই সম্ভব নয় ।
________________
ডা. দীপংকর মন্ডল
ডিএইচএমএস(ঢাকা)
১৯/১১/২০২১

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪