সিওপিডির কারণ, লক্ষণ ও হোমিপ্যাথিক চিকিৎসা

প্রাথমিক আলোচনাঃ আজকের আর্টিকেলে আমি সিওপিডি রোগটির সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রবন্ধের ভেতর যে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেগুলো হলো COPD(Chronic obstructive pulmonary disease) কি? সিওপিডির কারণ? সিওপিডির লক্ষণ?  সিওপিডি রোগ নির্ণয়? সিওপিডির চিকিৎসা এবং সিওপিডি ভালো করার উপায় ইত্যাদি বিষয় সহ আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ বিষয়ক তথ্য নিয়ে আজকের আলোচনা পর্বটি। তো চলুন মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।

সিওপিডি কি? 

ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ(COPD) সিওপিডি একটি প্রাণঘাতী ফুসফুসের রোগ যা শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকে বাধা দান করে শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করে। Emphysema এবং Chronic bronchitis রোগ দুটিও ফুসফুস সম্বন্ধীয় কষ্টকর রোগ উপসর্গ সৃষ্টি করে বলে কখনো কখনো এদের COPD হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সিওপিডি আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুস শ্লেষ্মা দ্বারা পূর্ণ হয়ে কষ্টকর রোগ উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। কখনোবা এদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রধান কষ্ট ফুসফুস এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সম্বন্ধীয় হয়ে থাকে।

সিওপিডির কারণ, লক্ষণ ও হোমিপ্যাথিক চিকিৎসা
সিওপিডি ছবি

পোষ্ট সূচিপত্রঃঅন্যভাবে বলা যায় সিওপিডি ফুসফুসের রোগের এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে নিউমোনিয়া, ক্রনিক ব্রংকাইটিস, এমফাইসিমা, ক্রনিক অবসট্রাকটিভ এয়ারওয়েজ ডিজিজ ইত্যাদি এর কোন একটি বা একই সঙ্গে একাধিক রোগ দ্বারা রোগী আক্রান্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় রোগীর শ্বাসনালী সংকুচিত হওয়ার ফলে ফুসফুসে বায়ু প্রবাহে বাধা পায়। 

সিওপিডির কারণঃ 

রোগের সূক্ষ্ম কারণ হিসেবে মায়াজোমেটিক কারণ এর উল্লেখ করা যায়। জীবনী শক্তির দুর্বলতাও সূক্ষ্ম কারণে অন্তর্ভুক্ত। 

আর স্থুল ও উত্তেজক কারণ যেগুলো সিওপিডি পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য দায়ী সেগুলো হলঃ

ধূমপানঃ সিওপিডি রোগের প্রধান কারণ হলো ধূমপান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয় প্রকার ধূমপানই COPD রোগটি হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। দীর্ঘদিন যাবত ধূমপানে অভ্যস্ত ব্যক্তির এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। 

বায়ু দূষণঃ কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, যানবাহন ও ইঞ্জিনের ধোঁয়া, বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ধোঁয়া ইত্যাদি দ্বারা প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে যে বায়ু সেই রকম পরিস্থিতির নিকটে ক্রমাগত অবস্থান করলে COPD এর মত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি অধিক।

এছাড়াও বিভিন্ন রাসায়নিক এর দূষণ এর প্রভাবও রোগটি হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে।

ধূলিকণা প্রবেশঃ কর্মক্ষেত্রে বা বাসস্থানের নিকটে বাতাসে যদি অধিক পরিমাণে ধূলিকণা মিশে থাকে এবং প্রতিনিয়ত তা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে তাহলে ফুসফুস রোগাক্রান্ত হতে পারে এবং সিওপিডির মত অবস্থা তৈরি হতে পারে।

শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণঃ বারংবার ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া এর মতো রোগ দ্বারা সংক্রমিত হলে সেক্ষেত্রে COPD হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

বংশগত প্রবণতাঃ COPD বা ফুসফুস এর এই জাতীয় রোগ এর পারিবারিক ইতিহাস থাকলে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি হতে পারে। 

সিওপিডির লক্ষণ ও উপসর্গঃ 

যেহেতু রোগটি দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাই রোগটির প্রধান উপসর্গ হিসেবে শ্বাসকষ্ট এবং কাশি থাকতে দেখা যায়। সমস্যাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে সারা বছর ধরে এরূপ ফুসফুস সংক্রান্ত কষ্টকর রোগ উপসর্গ থাকতে দেখা যায়। সমস্যাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখা যায়। অনেক সময় বুকে অধিক পরিমাণে শ্লেষ্মা জমতে পারে। অনেক সময় রোগী শুকিয়ে যেতে থাকে এবং রোগীকে রোগীর ওজন কমে যায়। এই সকল লক্ষণযুক্ত রোগীর ক্ষেত্রে প্রায়ই ধূমপানের ইতিহাস পাওয়া যায়। 

প্যাথলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনঃ 

শ্বাসনালী এবং ফুসফুস ভালোভাবে কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য স্পাইরোমেট্রি (Spirometry) টেস্ট টি করা যেতে পারে।

ফুসফুসের ফাংশনগুলোর সক্ষমতা কেমন আছে এবং নিঃশ্বাস দ্বারা গ্রহণ করা যায় বায়ু কত দ্রুত ফুসফুস বের করে দিতে পারছে তা পরিমাপ করা যায় এই টেস্টটি দ্বারা। 

আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস(ABG): রক্তের অক্সিজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাপ দ্বারা এটি দেখা হয় যে ফুসফুস কার্যকর ভাবে এবং সঠিক মাত্রায় রক্ত অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বিনিময় করছে কিনা? 

চেস্ট এক্সরেঃ বুকের এক্সরে করে বুক বা ফুসফুস সংক্রান্ত কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা? ফুসফুসে জল বা পূজ জমেছে কিনা? ফুসফুসের আকার, ব্রঙ্কাই এর পুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জানা যায়।

চেস্ট সিটিস্ক্যানঃ এই টেস্টটির দ্বারা ফুসফুসের এবং বুকের অঙ্গ গুলোর বিস্তারিত ছবি পাওয়া যাবে। 

এছাড়াও রক্ত পরীক্ষা দ্বারাও কিছু বিষয়ের মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যেমন- আলফা-1 এন্ট্রিট্রিপসিন এনজাইম এর ঘাটতি জনিত কারণে সিওপিডি হলে তা রক্ত পরীক্ষা দ্বারা সনাক্ত করা সম্ভব।

এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বায়োপসি টেস্ট করানোর প্রয়োজন হতে পারে। 

সিওপিডির হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ 

বিশেষ কি কারণ থেকে রোগাবস্থা বিকাশ লাভ করেছে সর্বাগ্রে তা অন্বেষণ করতে হবে চিকিৎসক কে। রোগীর রোগ লক্ষণসমূহ সংগ্রহের সাথে সাথে সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ সমূহ সংগ্রহ করতে হবে। লক্ষণ সাদৃশ্যে একক শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীকে প্রয়োগ করতে হবে। সুযোগ থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রোগীর জন্য উপযুক্ত মায়াজমেটিক ঔষধ উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করলে ধাতুগত বাধা অপসারিত হবে। লক্ষণ সাদৃশ্যে হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা থেকে যেকোন ঔষধই রোগীর জন্য নির্বাচিত হতে পারে। 

আমি এক্ষেত্রে সিওপিডি রোগের জন্য সম্ভাব্য ও বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের উল্লেখ করছিঃ

Arsenic alb, Antimonium tart, Antimonium ars, Bryonia alb, Aconite nap, Carbo veg, Gelsemium, Nux vom, Tuberculinam, Sulphur, Senega ইত্যাদি।

আশু শ্বাসকষ্টের উপশম করতে কিছু ঔষধের মাদার টিংচার এর ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন একোনাইট ন্যাপ, ব্লটা ওরি, সেনেগা ইত্যাদি।

মাদার টিংচার ঔষধ নির্দিষ্ট পরিমাণে জলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগের পাশাপাশি নির্বাচিত মাদার টিংচার ঔষধটিও এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে দ্রুত উপশম এর জন্য। তবে মনে রাখতে হবে শুধু একক ঔষধ বিশেষ করে শক্তিকৃত ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা রোগ আরোগ্যই সর্বোত্তম এবং তাতে প্রয়োগ কৃত ঔষধের ক্রিয়া উপলব্ধিতে সুবিধা হয়।

সিওপিডির ব্যবস্থাপনাঃ 

বলা হয়ে থাকে-সিওপিডি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এবং এটির সম্পূর্ণ আরোগ্যযোগ্য কোন চিকিৎসা নেই। তবে দেখা গেছে জীবনীশক্তি সর্বোত্তম স্তরে থাকলে এবং সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীকে উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করতে পারলে সিওপিডি আরোগ্য হতে পারে। 

সিওপিডির কারণ, লক্ষণ ও হোমিপ্যাথিক চিকিৎসা
সিওপিডি ছবি

আর যে সকল ক্ষেত্রে রোগটি পরিপূর্ণ আরোগ্য হয় না তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ লক্ষণের তীব্রতা কমিয়ে রোগীকে অনেকটাই ভালো রাখা সম্ভব হয়। COPD রোগীদের বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দ্বারা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য সহযোগিতা করা যায়।

এ সকল ক্ষেত্রে রোগীকে রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এই রোগের কারণ, লক্ষণ এবং পরিণতি সম্পর্কে রোগীর ধারণা থাকলে এবং কখন রোগী চিকিৎসকের কাছে যাবে তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে রোগীর জন্য সহজ ও নিরাপদ জীবন যাপন সম্ভব হবে। ধুমপায়ী রোগীদের ধুমপান বর্জনের জন্য পরামর্শ, কৌশল ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।

রোগীর জন্য উপযোগী বিভিন্ন শরীরচর্চা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম(Breathing exercises) এর অনুশীলন ফুসফুসের কার্যকারিতা কে বৃদ্ধি করতে পারে। 

COPD আক্রান্ত রোগীদের প্রায়ই পুষ্টির ঘাটতি দেখা যায়। তাই রোগীকে নিয়মিত শরীরচর্চার অনুশীলনের সাথে সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। 

রোগের বিষয়ে রোগীকে ব্যক্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি পূর্বক স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের অভ্যাস করতে হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ান্তর ফলোআপের জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে।

শেষ কথাঃ চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সিওপিডির থেকে রক্ষা পেতে জীবনধারার পরিবর্তন অপরিহার্য। অবশ্যই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে এবং রোগের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর নজর রাখতে হবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ আমার চিকিৎসা জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি সিওপিডি রোগীরা অনেক সময় মানসিক দুর্বলতা থেকে বিষন্নতায় ভুগে থাকে। এই সকল ক্ষেত্রে মানসিক উৎসাহ ও আশাবাদ জাগ্রত করে তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রতি অনুপ্রাণিত করতে হবে। একটু মার্জিত জীবনাচরণ দ্বারা যে সম্পূর্ণ ভালো থাকা যায় এটি রোগীকে বোঝাতে হবে।

সকলের জন্য অসংখ্য কামনা।

আরো পড়ুনঃ
নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
1 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • বাদল হালদার
    বাদল হালদার ৯ জুলাই, ২০২৪ এ ৯:৩৫ PM

    সিওপিডি একটি জটিল পরিস্থিতি মনে হয় আমার কাছে। শ্বাশনালীর শুরুর দিকে কি যেন একটা আটকে আছে এইরকম মনে হয় আমার কাছে। মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়। খুলনায় একজন মেডিকেল ডাক্তার আমার মানসিক চিন্তা এই রোগের সাথে যুক্ত আছে তাই বলেছে। একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কিছুদিন আগে নিউমোনিয়া হিসাবে চিকিৎসা করেছে কিছুদিন। আমার এখনও মাঝে মাঝে ঢোক গেলার সময় অস্বস্তি বোধ হয়।

    এখন আমি কি করতে পারি?

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আইটিচহেলথ এর নীতিমালা মেনে তবেই মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। প্রত্যেকটি মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে যাচাই করা হয়।

comment url