ajkerit

মাইগ্রেনের লক্ষণ ও তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

ভূমিকাঃ  এই আর্টিকেলে আমি মাইগ্রেন সম্বন্ধে আলোচনা করব। মাইগ্রেন কি? মাইগ্রেন কেন হয়? মাইগ্রেনের লক্ষণ, কারন ও চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করব। চলুন মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।

মাইগ্রেন শব্দের উৎপত্তিঃ 

গ্রিক শব্দ “হেমিক্রানিয়া” থেকে মাইগ্রেন শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। হেমি এর অর্থ অর্ধেক এবং ক্রানিয়া শব্দের অর্থ খুলি। মাইগ্রেনে মাথার অর্ধেক অংশ জুড়ে সাধারণত ব্যথা হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো মাথার উভয় পাশেই বা সমস্ত মাথা জুড়ে ব্যথা হতে পারে।

গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস এই মাইগ্রেনকে “হেটেরোনিমালজিয়া” বলে উল্লেখ করেছিলেন যার অর্থ “অন্য ধরনের ব্যাথা”।

রোমানরা পরবর্তীতে এটিকে হেমাক্রানিয়া নামে ব্যবহার করতে থাকে এবং আজও এই শব্দটিই ব্যবহৃত হচ্ছে মাইগ্রেনকে বোঝাতে।

মাইগ্রেন

মাইগ্রেনের লক্ষণঃ

মাইগ্রেনের লক্ষণ গুলো কি কি এই ব্যাপারে এখন আলোচনা করব।

১) মাথা ব্যথাঃ সাধারণত মাথার কোন এক পাশে অত্যাধিক বেদনা হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো মাথার উভয় পাশে এবং সম্পূর্ণ মাথা জুড়েও ব্যথা হতে পারে। মাথা ব্যাথা মাঝারি থেকে তীব্র ধরনের হতে পারে। এবং এই মাথাব্যথা অল্প কয়েক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

২) স্পর্শকাতরতা ও অত্যানুভূতিশীলতাঃ মাইগ্রেনের ব্যথার আক্রমণের সময় রোগী প্রচন্ড উত্তানুভূতিশীল হতে পারে। কোন কোন রোগের ক্ষেত্রে আলো ও শব্দের প্রতি  অত্যানুভূতিশীলতা দেখা যায়। অর্থাৎ তারা মাইগ্রেনের মাথা ব্যাথার আক্রমণের সময় শব্দ ও আলো সহ্য করতে পারে না। আলোর দিকে রোগী তাকাতে পারে না মোটেই।

৩) বমি ভাব ও বমিঃ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রচন্ড মাথা ব্যাথার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বমি বমি ভাব থাকে অথবা বমি হয়ে থাকে।

৪) দুর্বলতা এবং ক্লান্তিঃ রোগী সামগ্রিকভাবে প্রচন্ড দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব করে। কিছু কিছু রোগী এমন অসুস্থতা অনুভব করে যে বিছানা ছেড়েই উঠতে পারে না।

৫) ঘুমের সমস্যাঃ অনেক সময় রোগীর ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। রোগী ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। 

৬) দৃষ্টি বিভ্রমঃ মাইগ্রেনের আক্রমণের শুরুতে কারো কারো ক্ষেত্রে দৃষ্টি বিভ্রম হতে পারে। অর্থাৎ তারা চোখের সামনে কিছু অস্বাভাবিক বস্তুর দর্শন করতে পারে। কখনো কখনো দ্বিত দর্শন করতে পারে।

৭) মেজাজ এর পরিবর্তনঃ মাইগ্রেনের এই সমস্যা কালীন রোগী প্রচন্ড পরিমাণ ক্লান্তি, দূর্বলতা ও শারীরিক অসুস্থতা বোধ করে। ফলশ্রুতিতে রোগীর স্বাভাবিক মেজাজ মর্জির পরিবর্তন হতে দেখা যায়। এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগী বিষন্নতা এর শিকার হয়ে থাকে।

এছাড়াও আরো নানাবিধ মাইগ্রেনের ব্যাথার লক্ষণ রোগী বিশেষে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা দিতে পারে।




মাইগ্রেন কেন হয়ঃ

কিছু ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের কারণ স্পষ্ট রূপে জানা যায় না। তবে মাইগ্রেন একটি স্নায়বিক রোগ। স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়ার ভারসাম্যহীনতার কোন সূক্ষ্ম কারণ থেকে রোগটি হয়ে থাকে। মাইগ্রেন রোগটি হওয়ার পেছনে ধাতুগত বা মায়াজমেটিক এবং পরিবেশগত কারণ জড়িত থাকে। অনেক সময় বংশগত একটা প্রবনতা রক্ষা করা যায়। অর্থাৎ পরিবারের অন্য কোন সদস্যের মাইগ্রেনের সমস্যা থাকলে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

আর সমস্যাটির পেছনে পরিবেশগত কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানসিক চাপ, অতিরিক্ত গরম বা রৌদ্রের উত্তাপ, ঘুমের অভাব, ক্যাফেন সমৃদ্ধ পানিয় বা অ্যালকোহল পানের আধিক্য, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এবং কখনো কখনো কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকেও মাইগ্রেন রোগটি হয়ে থাকে।

মাইগ্রেনের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ 

যদিও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে মাইগ্রেন সম্পূর্ন নিরাময় নেই। ঔষধের ব্যবহার এবং জীবন ধারনের পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলা হয়। 

তবে দেখা গেছে বেশিরভাগ মাইগ্রেনের সমস্যাই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে। মাইগ্রেনের সমস্যা দূর করার উপায় বা মাইগ্রেন সমস্যার সমাধান আছে হোমিওপ্যাথিতে। অন্যান্য রোগের মতো মাইগ্রেনের চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে লক্ষণ ভিত্তিক। রোগীর রোগ লক্ষণ এবং সর্বদৈহিক ও মানসিক লক্ষণ এর সঙ্গে মিলিয়ে ধাতুগত ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে মাইগ্রেনের সমস্যা চিরতরে নির্মূল হয়ে থাকে। নিচে মাইগ্রেনের জন্য সচরাচর ব্যবহৃত কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের উল্লেখ করা হলো। ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই রোগের লক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। 

নেট্রাম মিউরঃ আট কপালে মাথা ব্যথার জন্য নেট্রাম মিউর একটি খুবই ভালো ঔষধ। যদি রোগীর শরীরে গরম বেশি থাকে। রোগীর লবণের প্রতি আকাঙ্ক্ষা প্রচন্ড হয় এবং রোগীর প্রচুর পরিমাণে পিপাসা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর  কোষ্ঠকাঠিন্য থাকতে দেখা যায়।

রোগী লম্বা-পাতলা গড়নের। সঠিকভাবে ঔষধটি প্রয়োগ করতে পারলে তা হবে মাইগ্রেন থেকে মুক্তির উপায়।

থুজা অক্সিডেন্টালিসঃ রোগী সাইকোটিক ধাতুর হয়ে থাকে। সকলের রোগ লক্ষণ এবং বংশগত ধারা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সাইকোটিক ধাতুর প্রভাব রোগীর ভেতর প্রত্যক্ষভাবে বর্তমান থাকে। রবি শীতকাতুরে হয়ে থাকে। শরীরের টিউমার বা আচিঁলের ইতিহাস থাকতে পারে। রোগী প্রায়ই মৃত ব্যক্তির স্বপ্ন, উপর থেকে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন, উপর থেকে পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন এই সকল স্বপ্ন দেখে থাকে। ইত্যাদি লক্ষণে থুজা প্রয়োগে মাইগ্রেনের সমস্যা আরোগ্য হবে। 

স্পাইজেলিয়াঃ হাত কপালে মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সমস্যার এটি একটি খুব ভালো ঔষধ। এই ঔষধ কি রোগের মাথাব্যথা সাধারণত বাম দিকেই অধিক দেখা যায়। অথবা বাম দিকে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে পরবর্তীতে ডান দিকে প্রসারিত হয়। 

স্যাঙ্গুনেরিয়াঃ স্পাইজেলিয়া ওষুধটিতে যেমন বাম পাশে মাথাব্যথা শুরু হয়ে ডান পাশে সম্প্রসারিত হয়। স্যাঙ্গুনেরিয়া ওষুধটিতে স্পাইজেলিয়ার বিপরীত অর্থাৎ ডান পাশে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে তা সম্প্রসারিত বাম পাশে আসে।

নেট্রাম কার্বঃ রোগীর রোদ্দুর ভীষণভাবে অসহ্য। রোদ্রের উত্তাপে তার মাথাব্যথা বৃদ্ধি হয়। নেট্রাম কার্বের রোগীর সাধারণত সহবাসের প্রতি অনিচ্ছা থাকে। লক্ষণ সাদৃশ্যে ওষুধটি প্রয়োগে মাইগ্রেন ব্যাথার উপশম হবে এবং ক্রমাগত রোগটি আরোগ্য হবে।

ল্যাকেসিসঃ এর রোগীর মাথা ব্যাথা সূর্যতাপ এবং গ্রীষ্মের উত্তাপ উভয়ের ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পায়। এর রোগীরা সাধারণত সাপের স্বপ্ন বেশি দেখে। প্রায়ই এই ঔষধের রোগীদের টনসিলাইটিস এর সমস্যা থাকতে দেখা যায়।

এছাড়াও ধাদুগত লক্ষণ সাদৃশ্যের যে কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধি রোগের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।

মাইগ্রেন বিষয়ক প্রশ্ন উত্তর পর্বঃ

এখন আমরা মাইগ্রেনের ব্যথা বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো সাধারণত গুগলে বিভিন্ন ব্যক্তিরা সচারচর প্রশ্ন করে থাকেন। মাইগ্রেনের বেদনা বিষয়ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বহুজন জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী নিয়ে এই পর্ব।

প্রশ্নঃ মাইগ্রেন হলে কি ক্ষুধা লাগে?

উত্তরঃ মাইগ্রেনের সমস্যাটি সাধারণত ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে অধিক ক্ষুধা লাগতে পারে। আমার কারো কারো ক্ষেত্রে ক্ষুধা হ্রাস হতে দেখা যায়। তবে সচেতন থাকতে হবে এই সময়ে শরীর হাইড্রেট থাকে তাই পরিমিত পরিমাণে জল পান করুন। সহজপাচ্য আহার করুন। জরুরী প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। 




প্রশ্নঃ মাইগ্রেন হলে কি চোখে ব্যথা হয়? 

উত্তরঃ মাইগ্রেনের ব্যাথার সময় চোখে ব্যথা হওয়া একটি সাধারন লক্ষণ। মাথা ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে চোখ জুড়েও বেদনা অনুভব হতে পারে। এর সাথে সাথে ফটোফোবিয়া, ঝাপসা দৃষ্টি, দ্বিত দৃষ্টি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। স্নায়বিক কারণবশত মাইগ্রেনের মাথা ব্যাথার সাথে সাথে চোখে ব্যথার অনুভূতি হয়ে থাকে।

প্রশ্নঃ মাইগ্রেন হলে কি রক্তচাপ হয়? 

উত্তরঃ এটি রোগের তীব্রতা অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এই ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট তথ্য নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের আক্রমণের সময় রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মাইগ্রেনের ব্যথা এবং রক্তচাপের ভেতরে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। নিজের সচেতন থাকুন ও সাবধানে থাকুন। নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করুন। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ধূমপান পরিত্যাগ করুন। স্বাস্থ্য করা আর করুন এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।

প্রশ্নঃ ঘনঘন মাথা ব্যথার কারণ কি? 

উত্তরঃ কোন ব্যক্তি ঘন ঘন মাথা ব্যথা আক্রান্ত হতে লাগলে সেখানে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। ব্যথাটি মাইগ্রেনের হতে পারে। টেনশন টাইপ হেডেক হতে পারে। সাইনাস হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি হতে পারে। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। আপনার এই জাতীয় ঘনঘন মাথা ব্যথার সমস্যা থাকলে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

আরো পড়ুনঃ
জ্বরের প্রকারভেদ, ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসা

ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
১৯.০৫.২০২৪

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url
ajkerit
ajkerit
ajkerit
ajkerit