ajkerit

বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটিঃ কারণ লক্ষণ ও সমাধান

ভূমিকাঃ বন্ধ্যাত্ব শব্দটি শোনা মাত্রই এক অজানা আতঙ্ক এবং অনুভূতি মনে জাগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এর মতে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৫% দম্পতি বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টীলিটির সমস্যায় ভুগছেন। বন্ধ্যাত্ব সমস্যাটি যেমন পারিবারিক জীবনে ছন্দপতন ঘটাতে পারে। তেমনি ভুক্তভোগী দম্পতিদের মানসিক অবস্থার উপরও বিরাট প্রভাব ফেলে। এই লেখাটিতে আমরা বন্ধ্যাত্বের কারণ লক্ষণ সমাধান প্রতিরোধ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

বন্ধ্যাত্ব কি?

কোন স্বাস্থ্যবান দম্পতি এক বছরের অধিক সময়কাল যাবত নিয়মিত স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক করার পরেও যদি গর্ভধারণে ব্যর্থ হয় তাকে ইনফাটালিটি বা বন্ধ্যাত্ব বলে। অর্থাৎ গর্ভধারণ রোধের কোন পদ্ধতি ছাড়া এক বছরের অধিক সময়কাল যাবত নিয়মিত যৌন মিলন সত্ত্বেও কোন দাম্পতি গর্ভধারণে ব্যর্থ হলে তাকে ইনফার্টিলিটি বলা হয়। এই ক্রমবর্ধমান সমস্যাটিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৫% দম্পতি ভুগে থাকেন।

বন্ধ্যাত্বের কারণঃ

এখন আমরা ইনফার্টিলিটির কারণ নিয়ে আলোচনা করব। মেয়েদের ইনফার্টিলিটির কারণ এবং পুরুষদের ইনফার্টিলিটির কারণ আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। আবার কিছু কারণ আছে যেগুলো উভয়কেই প্রভাবিত করে।

মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের কারণঃ

মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের যে সকল কারণ দেখা যায় তা হলঃ

ডিম্বাণুর উৎপাদন কম হওয়াঃ ডিম্বাশয় বা ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজের কারণে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া।

জরায়ুর সমস্যাঃ জরায়ুর নানাবিধ সমস্যা থেকে ইনফার্টিলিটির সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পলি সিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ(PCOD): পলিসিস্টিক ওভারি এন্ড ডিজিজ এর সমস্যা থাকলে অনেক সময় গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

এন্ডোমেট্রিয়োসিসঃ সমস্যাটি থাকলে গর্ভধারণ ব্যর্থ হতে পারে।

থাইরয়েডঃ থাইরয়েড হরমোন এর ভারসাম্যহীনতা থাকলে আরেক সময় গর্ভধারণে অসুবিধা হয়।


বন্ধ্যাত্ব


পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের কারণঃ

পুরুষদের ক্ষেত্রে যে সকল প্রধান কারণ দেখা যায় তা হলঃ

শুক্রাণুর সংখ্যা কমঃ WHO এর ২০২১ সালের সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী একজন পুরুষের প্রতি মিলি লিটার বীর্যে ন্যূনতম ১৬ মিলিয়ন স্পার্ম কাউন্ট থাকতে হবে। এই মানের কম সংখ্যায় শুক্রাণু থাকলে তাকে অলিগোস্পারমিয়া (oligospermia) বলে।

শুক্রাণুর গতিশীলতা কমঃ ডিম্বানুকে নিষিক্ত করার জন্য শুক্রানুর ছুটে যাওয়ার গতিতে বলে (Sperm motility)। শুক্রাণুর দ্রুত সাঁতার কাটার সক্ষমতা না থাকলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যায়।

শুক্রাণুর স্বাভাবিক আকৃতিঃ বীর্যে উপস্থিত শুক্রানুর স্বাস্থ্য বা আকার গত স্বাভাবিকতা বজায় না থাকলে তা ইনফার্টিলিটির কারণে হয়ে থাকে।

এছাড়াও শুক্রাণুর জিনগত কোন ত্রুটি থাকলে সে ক্ষেত্রে গর্ভধারণে অসুবিধা হতে পারে। 

স্বামী স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই কিছু বিশেষ কারণ যেমন যৌন সংক্রামিত কিছু রোগ (Venereal disease) সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্লামিডিয়া ইত্যাদির সংক্রমণ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বয়সজনিত কারণ, জীবন আচরণ, মানসিক চাপ, অশান্তকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মধ্যপান বা মাদক গ্রহণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পরিবেশগত কারণ ইত্যাদি থেকেও বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা:

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি হল ART(Assisted reproductive technology) যেটির ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুকে মিলিত করা হয় I IVF, IUI, ICSI, GIFT) ইত্যাদি সকল প্রজনন সহায়ক প্রক্রিয়া গুলো এই ART এর অন্তর্ভুক্ত।

আইভিএফ(IVF): এটি পরীক্ষাগারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে মিলিত করে কৃত্রিমভাবে ভ্রুণ তৈরীর একটি প্রক্রিয়া। একবার ভ্রূণ্য তৈরি হয়ে গেলে পরবর্তীতে তা জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।

আইসিএসআই(ICSI): এই পদ্ধতির ব্যবহার করে একটি শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুর ভেতরে স্থাপন করা হয়।

জেডআইএফটি(ZIFT): এই পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুকে ল্যাবরেটরীতে মিলিত করা হয় তার ফলে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণের মাধ্যমে যে জাইগট তৈরি হয় তা ফ্যালোপিয়ান টিউবে স্থাপন করানো হয়।

জিআইএফটি(GIFT): এই পদ্ধতিতে শুক্রাণু এবং ডিম্বানুকে সরাসরি ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।

আইইউআই(IUI): এই পদ্ধতি টি ব্যবহার করে জরায়ুতে শুক্রাণুকে সরাসরি প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।

কৃত্রিম গর্ভধারণের সফলতার হারঃ

কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সফলতার হার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর গুণগতমান, মায়ের বয়স, ব্যবহৃত পদ্ধতির ভূমিকা এছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ত্রুটির কারণেও এই হার পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

কৃত্রিম গর্ভধারণের ঝুঁকিঃ

কৃত্রিম গর্ভধারণের ক্ষেত্রে যে সকল ঝুঁকি দেখা যায় তা হলঃ বহু গর্ভধারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, জন্মগত ত্রুটি, ঔষধজ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। এছাড়াও মনে রাখতে হবে কৃত্রিম গর্ভধারণ সবসময় সফল নাও হতে পারে। কৃত্রিম গর্ভধারণের খরচ পরিমাণে বেশি হতে পারে।

এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।

বন্ধ্যাত্বের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

বন্ধ্যাত্বের সমস্যার সমাধানের জন্য হোমিওপ্যাথি কার্যকর বিকল্প চিকিৎসা হতে পারে। সঠিকভাবে নিয়ম মেনে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতে পারলে হোমিও ঔষধ দ্বারা ওভারির কার্যকারিতা বাড়তে পারে। ফলে ডিম্বাণুর উৎপাদন এবং ওভুলেশনে সহায়তা হতে পারে। জরায়ুর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পারে।

এছাড়াও কোন সিস্টেমিক ডিজঅর্ডার থাকলে বা হরমোনাল ইমব্যালেন্স থাকলে যেমন থাইরয়েডাইটিস ইত্যাদি থাকলে সেগুলোর সমাধান হতে পারে।

স্ত্রী লোকদিকের ক্ষেত্রে এবং পুরুষদের ইনফার্টিলিটির চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ঔষধের সঠিক প্রয়োগ হলে তা শুক্রাণুর সংখ্যা বাড়াতে পারে। এছাড়াও শুক্রাণুর গতিশীলতা, আকার ইত্যাদির মান কেও উন্নত করে থাকে হোমিওপ্যাথিক শক্তিকৃত ঔষধ।

এমনকি হোমিওপ্যাথিক ঔষধে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়। ফলে সামগ্রিক এই সকল সহায়তা লাভ করে রোগী গর্ভধারণে সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যায়।

পালসেটিলাঃ এই ঔষধের রোগীর মাসিকের অনিয়ম দেখা যায়। মাসিক ঋতুস্রাব পরিমাণে খুবই কম হয়ে থাকে। রোগী দেখতে মোটাসোটা গড়নের। রোগের শরীরে গরম বেশি লাগে। রোগী পিপাসাহীন।

সিপিয়াঃ ডিম্বাশার কার্যকারিতা কম হয়। রোগী বিষন্ন প্রকৃতির। সহবাসে ইচ্ছা থাকে না।

ল্যাকেসিসঃ মাসিকের রক্তপাতের পরিমাণ খুব বেশি। রক্তের রং কালো। চাপ চাপ রক্তচাপ হতে পারে। রোগী সাপের স্বপ্ন বেশি দেখে।

ক্যালকেরিয়া কার্বঃ  রোগী মোটাসোটা। থলথলে প্রকৃতির। শীত বেশি।

থুজাঃ লক্ষণ সাদৃশ্য থাকলে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় থুজা হোমিওপ্যাথিক ওষুধটি অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকরী হতে দেখা গেছে। বলা হয়ে থাকে স্ত্রী লোকেদের রিপ্রোডাক্টিভ অর্গান এর অনেক রোগই সাইকোটিক দোষ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে।

রোগীর শীত বেশি থাকে। আঁচিল বা টিউমারের ইতিহাস থাকতে পারে। মাইগ্রেনের সমস্যা থাকতে পারে। রোগী ঘুমের ভেতর মৃত ব্যক্তির সপ্ন, উপর থেকে উড়ে যাওয়া বা উপর থেকে পড়ে যাওয়া ইত্যাদির স্বপ্ন দেখে থাকে।

প্রধান কথা রোগীর সকল শারীরিক মানসিক এবং আঙ্গিক লক্ষণ খাতায় লিখে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। তারপর বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা রোগের কোন গুরুতর কারণ পাওয়া যায় কিনা সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে। এবং লক্ষণ সাদৃশ্য অনুযায়ী শক্তি কৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের প্রয়োগে রোগীর শরীর নির্মল হবে এবং রোগী গর্ভধারণের সমর্থ হবে।

বন্ধ্যাত্বের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সুবিধাঃ

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ব্যবহারে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন 

প্রাকৃতিক ও নিরাপদঃ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বরাবরই নিরাপদ হয়ে থাকে সকল রোগের ক্ষেত্রে। এই চিকিৎসার তেমন কোন বড় ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।

কার্যকারিতাঃ সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ইনফার্টিলিটির আরোগ্যের বহু অভিজ্ঞতা হোমিওপ্যাথির আছে। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি খুবই কার্যকরী একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা।

অল্প খরচঃ সাধারণত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে কম খরচে করানো যায়। তবে সঠিক চিকিৎসা পেতে কিছু ক্ষেত্রে সামান্য বেশি খরচ হতে পারে। তবুও তা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি তুলনায় অনেক কম হবে।

অবশ্য একজন অভিজ্ঞ ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসককে পূর্বের চিকিৎসার সকল ইতিহাস খুলে বলতে হবে। অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবন করে যেতে হবে।

আরো পড়ুনঃ
যোগাসন এর অনুশীলন করুন জীবন বদলাবেই

এই লেখাটি ইংরেজীতে পড়ুনঃ
Infertility: Causes, Symptoms and Solutions

ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
০২.০৪.২০২৪

————————–

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url
ajkerit
ajkerit
ajkerit
ajkerit