মৃগী রোগ কি? লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা|

মৃগী রোগের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসাঃ

ভূমিকাঃ মৃগী রোগের উপর বিস্তারিত আলোচনা করবো আজকের পোস্টে। মৃগী রোগ কি? রোগের কারণ? রোগের লক্ষণ? মৃগীর রোগ নির্ণয়, রোগটির চিকিৎসা সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর উপরে আলোচনা করব।

মৃগী রোগ কি? 

মৃগী নার্ভাস সিস্টেমের গোলযোগ জনিত একটি রোগ। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অস্বাভাবিকতা বসত মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষ নিউরনের কার্যকলাপ এ ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে বারবার খিচুনি, অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান হারানো, কিছুক্ষণের জন্য স্বাভাবিক আচরণের লোপ ইত্যাদি রোগ লক্ষণ দেখা দেয়।

অতএব মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের অস্বাভাবিকতা বশত বারংবার খিচুনি, চেতনা হারানো সহ অন্যান্য রোগ লক্ষণ দেখা দিলে তাকে মৃগী বলে।




মৃগী রোগের কারণঃ

যেসব কারণ থেকে মৃগী বা এপিলেপ্সি হয়ে থাকে তা হলঃ

জেনেটিক কারণঃ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রোগটি থাকলে তা জেনেটিক ভাবে অন্যান্য সদস্যদের ভেতরে আসতে পারে।

মস্তিষ্কে আঘাতঃ মাথায় কোন আঘাতের থেকে রোগটি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রোক, টিউমার ইত্যাদিতে থেকেও মৃগীর রোগটি হয়ে থাকে। অনেক সময় নবজাতক বা শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মগত ট্রমা বা মাথায় আঘাত লাগা থেকেও রোগটি হতে পারে।

মৃগী রোগ

জন্মগত অস্বাভাবিকতাঃ কনজেনিটাল এবনরমালিটি বা জন্মগত ত্রুটি থেকে রোগটি হতে পারে। অনেক সময় বাচ্চারা জন্মের সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেলে বা অক্সিজেন পেতে বিলম্ব হলে মৃগীর সমস্যা দেখা দিতে পারে। সময়ের পূর্বে যে সকল বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে কিছু ক্ষেত্রে তাদের মৃগীর মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বিকাশের সমস্যাঃ কোন শিশুর যদি মাইলস্টোন গ্রোথ নিয়ে কোন অসুবিধা থাকে যেমন জন্মের পর থেকে বয়সের সাথে সাথে তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বা বেড়ে ওঠার ভারসাম্য না থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশি হয়।

স্নায়ুগত সমস্যাঃ  মস্তিষ্কের স্নায়ুতে কোন সিস্টেমিক ডিসঅর্ডার থাকলে সেই কারণে মৃগীর সমস্যা হতে পারে।

ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ কিছু কিছু ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে রোগটি হতে পারে।

এছাড়াও জীবন আচরণের আরো নানা ত্রুটি যেমন মাদক সেবন, মদ্যপান, প্রচন্ড মানসিক চাপ, ইত্যাদি পরিস্থিতি থেকেও অনেক ক্ষেত্রে রোগটি হতে পারে।

মৃগী রোগের লক্ষণঃ 

এখন এপিলেপ্সি রোগের প্রধান প্রধান লক্ষণ গুলো নিয়ে আলোচনা করছি।

খিঁচুনিঃ মৃগীতে খিঁচুনী আরম্ভ হলে পুরো শরীরে অথবা শরীরের কিছু অংশ হঠাৎ শক্ত হয়ে যাওয়া, হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাওয়া এবং চোয়াল এঁটে আসার মত সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এই সময় হাত ও মুখ খুব শক্ত হয়ে এটে যায় এবং টেনে খোলা কষ্টকর হয়।

জ্ঞান হারানোঃ খিচুনি শুরু হওয়ার সাথে সাথে আংশিক বা সম্পূর্ণ চেতনা হারাতে পারে। রোগী অচেতন পড়ে থাকে। 

শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্টঃ খিঁচুনি আরম্ভ হলে অনেক সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়ে থাকে।

জিহ্বাতে কামড়ঃ খিঁচুনির সময় মুখ, হাতের মুঠি এসব প্রচন্ড শক্ত ভাবে এটে যায় ফলে এ সময় অনেক ক্ষেত্রে দাঁতের ফাঁকে জিহ্বা এঁটে গিয়ে তাতে কামড় লাগতে পারে।

মলমূত্র ত্যাগঃ অনেকের খিঁচুনির সময় মলমূত্র ত্যাগ হয়ে যেতে দেখা যায়।

এছাড়াও খিঁচুনি পরবর্তী দুর্বলতা, অস্বাভাবিক আচরণ, মন-মেজাজ এর পরিবর্তন, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এসব উপসর্গ গুলো অন্য রোগের লক্ষণ কিনা এটিও বিবেচনা করতে হবে।

কিছু দরকারি তথ্যঃ 

১) মৃগী কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, তাই একজন থেকে আরেকজনের ছড়ায়।
২) মৃগী রোগ স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি কে নষ্ট করে না। তাই রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

মৃগী রোগ নির্ণয়ঃ 

প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাগুলির ফলাফল দ্বারা সরাসরি রোগটি নির্ণয় করা যায় না। তবে পরীক্ষাগুলোর ফলাফল দেখে অনেক ক্ষেত্রেই মৃগী রোগটির কারণ বের করা সম্ভব হয়।

ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাঃ

একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রত্যক্ষভাবে রোগী দেখে রোগটি নির্ণয় করতে পারেন। রোগের ইতিহাস, খিঁচুনি কতক্ষণ স্থায়ী হয়? এ সকল বিষয় জেনে নেবেন। এছাড়াও রোগীর শারীরিক ও স্নায়বিক পরীক্ষা দ্বারা রোগটি নির্ণয় করা যেতে পারে। 

এই সকল ক্ষেত্রে রোগীর খিচুনিকালীন ভিডিও ধারণ করা থাকলে সেটি দেখে রোগ নির্ণয়ে অনেক সহায়তা হতে পারে।

প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাঃ

EEG-(Electroencephalography): পরীক্ষাটি দ্বারা মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক একটিভিটি রেকর্ড করা হয়।

MRI(Magnetic Resonance Imaging): মস্তিষ্কের বিশদ ও চিত্র পাওয়া যায় এবং মস্তিষ্কের ত্রুটি শনাক্ত করা যায়।

CT scan (Computed Tomography Scan): মস্তিষ্কের ছবি করে কার্যকলাপগত কোন অসুবিধা আছে কিনা দেখা হয়।

Blood test: ব্লাড টেস্ট দ্বারা শরীরের ইলেকট্রোলাইট এর ভারসাম্য, ইনফেকশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়।

Genetic testing: রক্তের পেছনে জেনেটিক মিউটেশনের কোন সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।

মৃগী রোগের চিকিৎসাঃ 

সাধারণত এপিলেপ্সি রোগটি একটি ক্রনিক ডিজিজ। অনেক সময় দেখা যায় মৃগী রোগটি চিকিৎসার দ্বারা পুরোপুরি সুস্থ না হলেও রোগ লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে দেখা গেছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দ্বারা মৃগী রোগীর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে যে চিকিৎসা পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক না কেন এই রোগে নিয়মিত ওষুধ সেবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনভাবেই ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। মৃগী রোগীদের ক্ষেত্রে সর্ব প্রথমে খিচুনি কমানোই আমাদের প্রথম লক্ষ্য।

মৃগী রোগীর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা যে কোন রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। লক্ষণ এর মিল থাকলে যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গুলি আমরা মৃগী রোগীদের ক্ষেত্রে নির্বাচন করতে পারি তা হল-

একোনাইটঃ ভয় পেয়ে যদি রোগের সূচনা হয় সেখানে একনাইট ঔষধটি প্রযোজ্য।

আর্নিকাঃ কোন প্রকার আঘাত জনিত কারণ রোগের সাথে জড়িত থাকলে সে ক্ষেত্রে আর্ণিকা ঔষধটি ভালো কাজ করে করবে।

চায়নাঃ অতিরিক্ত রক্তস্রাব এর কারণে দুর্বলতা, কানে ঝোঁ ঝোঁ শব্দ, মূর্ছা ভাব এসব ক্ষেত্রে সিন্কোনা ঔষধটি ভালো কাজ করে।

ক্যাম্ফরঃ রোগীর হিমাঙ্গ অবস্থা হয়। খিঁচুনি অবস্থায় রোগীর শরীর, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে থাকে।

স্ট্র্যামোনিয়ামঃ রোগীর চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং তা খোলা থাকে।

রোগী অজ্ঞান ভাবের সাথে খিঁচুনি হয়। এই পরিস্থিতিতে রুমালে ৮ থেকে ১০ ফোটা এমিল নাইট্রেট এর মাদার টিংচার ঢেলে সেটি রোগীকে শুকতে দিলে অথবা মূল আলোকের শিশি টি রোগের নাকের কাছে ধরলে রোগের প্রবলতা রাস হয়। সাধারণত মৃগী রোগে খিচুনি আরম্ভের কিছুটা পূর্বে শরীরে এক ধরনের সুঢ়সুড়ানি ভাব অনুভূত হয়। এই অবস্থায় এমিল নাইট্রেটের মূল আরোকের ঘ্রাণ পুনঃ পুনঃ গ্রহণ করলে তাতে রোগ আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

যেকোনো রোগে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করতে হবে।

মৃগী রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপনঃ

মৃগী রোগীকে খুব সচেতনভাবে জীবন যাপন করতে হয়। একা একা চলাফেরা না করাই উত্তম। কেননা যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে হঠাৎ মৃগির আক্রমণ বা খিচুনির আক্রমণ হলে এমনকি রোগীর প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।

পর্যাপ্ত ঘুমঃ রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোতে হবে।

সুষম খাদ্যঃ রোগীর খাবার তালিকা সুষম হতে হবে। রাজশিক খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।

শরীর চর্চাঃ নিয়মিত শরীরচর্চায় শরীরের গঠন সুসংহত হয়। শরীরে যেকোনো রোগ ব্যাধির বিপক্ষে তা প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলে।

মানসিক চাপ কমানোঃ যে কোন প্রকার মানসিক চাপ মৃগী রোগকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মানসিক চাপ মুক্ত থাকতে হবে।

সামাজিক মেলামেশাঃ সামাজিক মেলামেশা শাবলীর জীবন যাপনের সহযোগিতা করতে পারে। এবং তার ফলে মেঘের মতো রোগ লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা হতে পারে।

নিয়মিত চেকআপঃ মৃগী রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। 

এখন আমরা মৃগী রোগের উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করব।

প্রশ্নঃ মৃগী রোগ কি বংশগত?
উত্তরঃ কিছু ক্ষেত্রে এই রোগটি বংশগতভাবে এসে থাকে। তবে সকল ক্ষেত্রেই মৃগী রোগটি বংশগত নয়।

প্রশ্নঃ মৃগী রোগ কি ভাল হয়?
উত্তরঃ অনেক ক্ষেত্রে এই রোগ পুরোপুরি আরোগ্য না হলেও উপযুক্ত চিকিৎসা এবং সচেতন জীবনাচরণের মাধ্যমে খিচুনিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

আরো পড়ুনঃ
পলিপাস নাকি পলিপ কোন শব্দটি সঠিক?

ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
২৯.০৩.২০২৪

——————————-

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪