হাইড্রোনেফ্রোসিস হোমিও চিকিৎসায় ভালো হয়|

প্রাথমিক আলোচনাঃ আজকে আমি হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে যাচ্ছি। হাইড্রোনেফ্রোসিস এর কারণ? হাইড্রোনেফ্রোসিস এর লক্ষণ? হাইড্রোনেফ্রোসিস এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা? এই রোগের প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করব।

এটি একটি প্যাথলজিক্যাল অবস্থা যেখানে প্রস্রাব জমে থাকার কারণে একটি বা উভয় কিডনি ফুলে যায়। বিভিন্ন কারণ থেকে এই সমস্যাটি হতে পারে এবং এটি শরীরে কষ্টকর রোগ লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। রোগটির থেকে মুক্তি পেতে এর কারণ, লক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে হবে।

হাইড্রোনেফ্রোসিস কি?

আক্ষরিক অর্থে হাইড্রোনেফ্রোসিস হলো কিডনির ভেতরে জল জমা। যখন কিডনি থেকে প্রস্রাব সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারেনা তখনই কিডনিতে জল জমে। এর ফলে রেনাল পেলভিস প্রসারিত হয় এবং ফুলে যায়। সমস্যাটি একটি কিডনি অথবা উভয় কিডনির ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটি হলে প্রস্রাব প্রবাহে বাধা তৈরি হয় অথবা মূত্রতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত আরো অন্য কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর কারণঃ

রোগটি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। একটি প্রধান কারণ হলো কিডনিতে পাথর। এই পাথর কিডনি থেকে প্রস্রাব বেরিয়ে যেতে বাধা দেয়। ফলে কিডনি ফুলে যায়। এছাড়াও অন্যান্য কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মূত্রনালীর সংক্রমণUTI), টিউমার, ইউরেটার এ ব্লক ইত্যাদি । এছাড়াও জন্মগত অস্বাভাবিকতা এবং গঠনগত ত্রুটি এসব থেকেও এই রোগটি হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূত্রনালী থেকে কিডনিতে প্রসাব ফিরে আসার কারণেও হাইড্রোনেফ্রোসিস হতে দেখা যায় যাকে মেডিকেলের ভাষায় Vesicoureteral reflux বলে। 

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর লক্ষণঃ

রোগের কারণ এবং প্রচন্ডতার উপর নির্ভর করে রোগলক্ষণ বিভিন্ন রোগীতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণ লক্ষণ হিসেবে কিডনি অঞ্চলে বেদনা থাকতে পারে। বারবার প্রস্রাবের বেগ, প্রস্রাবের বেগ ধারনে অক্ষমতা, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি থাকতে পারে। এর সাথে রোগীর বমি বমি ভাব ও বমি এবং জ্বর থাকতে পারে যদি শরীরে কোন ইনফেকশন থেকে থাকে।

হাইড্রোনেফ্রোসিস নির্ণয়ঃ

রোগ নির্ণয় করতে রোগীর অতীত ইতিহাস জানার পাশাপাশি রোগীর আরো কিছু শারীরিক পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। এর সাথে অবশ্যই কিছু ইমেজিং পরীক্ষা করতে হয়। সাধারণত একটি আলট্রাসনোগ্রাম করে রোগীর মূত্রতন্ত্র, কিডনি এসবের অবস্থা এসব নির্ণয় করা যায়। এর সাথে সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই দ্বারা আরো স্পষ্টভাবে মূত্রতন্ত্রের ছবি এবং বাধাগুলো সম্পর্কে জানা যায়।

বাম কিডনি

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর চিকিৎসাঃ

রোগটির চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের কারণ, জটিলতা এবং রোগ লক্ষণের উপর নির্ভর করে। হাইড্রোনেফ্রোসিস এর চিকিৎসা সর্বদা কারণ এর উপর নজর রেখে এই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। কি কারনে কিডনিতে জল জমেছে এটি জানতে পারলে সেই অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগে রোগী সুস্থ হবে। যদি কিডনি পাথরের রোগের জন্য রোগটি হয়ে থাকে তবে ঔষধ সেবানের পাশাপাশি রোগীর জীবন যাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। গুরুতর ক্ষেত্রে বা পাথর খুব বেশি বড় হলে অবশ্যই সার্জারির মাধ্যমে তা অবসসারণ করতে হবে। যদি কোন ইনফেকশনের সাথে যুক্ত থাকে তবে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। যেকোনো প্রকার ইনফেকশন দূর করতে হোমিওপ্যাথিতে  খুব ভালো চিকিৎসা আছে।

এর সাথে সাথে রোগটির কারণ অপসারণ করতে হবে যেন রোগটি আবার পুনরায় আক্রমণ করতে না পারে।

হাইড্রোনেফ্রসিস এর ব্যবস্থাপনাঃ

কিডনির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং কিডনির পাথর প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করতে হবে। চিকিৎসা পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে এর সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, লবণ কম খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা এসব অভ্যাস করলে কিডনির সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং এই রোগ থেকে ধীরে ধীরে সেরে ওঠা সহজ হবে।

ইউরিন ফিল্টারেশন

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর প্রতিরোধঃ

রোগটি আরোগ্য হলেও আবার যেন ফিরে আসতে না পারে তার জন্য রোগটি প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব দিতে হয়। কিডনির সামগ্রিক স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে এবং মূত্রতন্ত্রের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন সুস্থ থাকে তার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হবে। পর্যাপ্ত জল পান করা, পরিমিত আহার করা পর্যাপ্ত পরিশ্রম করা এবং মূত্রতন্ত্রের যে কোন ইনফেকশন বা রোগ হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটি কাদের হয়?

সকল বয়স এবং সকল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হাইড্রোনেফ্রোসিস হতে পারে। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে।

জন্মগত ভাবেই কিছু বাচ্চা মূত্রতন্ত্রের গঠনগত অস্বাভাবিকতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ফলে খুব অল্প বয়সেই এই সকল শিশু হাইড্রোনেফ্রোসিস এ আক্রান্ত হতে পারে। অল্প বয়সী বাচ্চাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণত vesicoureteral reflux এবং ureteropelvic junction obstruction এসব থেকে হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটি হতে দেখা যায়।

কিডনিতে পাথরঃ যাদের পূর্বে কখনো কিডনি পাথুরী রোগের ইতিহাস আছে তাদের এই রোগটি হওয়ার ঝুঁকি অধিক। এই পাথর প্রস্রাবের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা তৈরি করে। তার ফলে প্রস্রাব জমে কিডনি ফুলে যেতে পারে।

মূত্রনালীর ইনফেকশনঃ (UTI) মূত্রনালী সংক্রমণ এর যথাযথ চিকিৎসা না হলে এবং বারবার মূত্রনালীর ইনফেকশন হলে হাইড্রোনেফ্রোসিস রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

মূত্রনালীতে টিউমারঃ ইউরিনারি ট্র্যাক্টের কোন গঠনগত বাধা বা সংকোচন থাকলে অথবা মূত্রনীতির টিউমার এর কারণে হাইড্রোনেফ্রোসিস হতে পারে। 

প্রেগনেন্সিঃ গর্ভাবস্থায় যখন জরায়ু বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তা মূত্রনালীর উপর চাপ দেয়। ফলে মূত্র প্রবাহে বাধা তৈরি হতে পারে এবং তা থেকে হাইড্রোনেফ্রোসিস হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সির শেষ ভাগেই এটা হতে দেখা যায়।

এছাড়াও জিনগত প্রবণতা এবং পেলভিক সার্জারি ইতিহাস থাকলে এই রোগটি হওয়ার ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে।

জেনে রাখা জরুরী যে এই পরিস্থিতি গুলো হাইড্রোনেফ্রোসিস ঝুঁকি বাড়ায় তবে এসব কারণ ছাড়াও অন্য যে কোন কারণ থেকেও এই রোগটি যে কারোরই হতে পারে।

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর খুব সুন্দর ও আরগ্যদায়ী চিকিৎসা রয়েছে হোমিওপ্যাথিতে। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তে দেখেছি হাইড্রোনেফ্রোসিস হোমিও চিকিৎসা তে সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়। এই রোগে  যে ঔষধ গুলো আমরা সর্বদাই বিবেচনা করব সেগুলো হলঃ

এপিস মেলঃ এই রোগে এপিস মেল খুবই একটি ফলপ্রসু ঔষধ। বাম পাশের কিডনিতে আক্রমণে এটি অধিক ফলপ্রসূ হয়। রোগীর গরম বেশি থাকে, পিপাসাহিন। এ জাতীয় লক্ষণ সাদৃশ্যে ঔষধটি ব্যবহারে রোগী সুস্থ হবে। মাত্র চার দিন বয়সী ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাম কিডনিতে সমস্যা এই একটি লক্ষণে এপিস মেল ঔষধটি প্রয়োগ করে এই রোগ সম্পূর্ণ সুস্থ হতে দেখেছি। কিভাবে সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলাম সবশেষে তা আলোচনা করব।

অ্যাপোসাইনামঃ এটিও হাইড্রোনেফ্রোসিস এর একটি ভালো ঔষধ। রোগীর পিপাসা অধিক এবং রোগী শীতকাতুরে।

আর্সেনিক এলবামঃ রোগীর খুব বেশি অস্থিরতা, ছটফটানি ভাব। খুব বেশি পিপাসা। যে কোন জ্বালা গরমে উপশম হয়। মৃত্যুভয় বেশি। এসব লক্ষণ সাদৃশ্যে আর্সেনিক ঔষধটি এই রোগ আরোগ্য করবে।

আর্জেন্টাম নাইট্রিকামঃ রোগী প্রচন্ড গরমকাতর। রোগী ভীষণ মিষ্টি প্রিয়। এই সকল লক্ষণে আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম ব্যাবহারে রোগটি দ্রুত আরোগ্য হবে।

উপরে উল্লেখিত ঔষধ ব্যতীত আরো যে কোন ঔষধই লক্ষণ সাদৃশ্যে প্রয়োগে রোগী সুস্থ হবে। যেমন সালফার, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম, থুজা ইত্যাদি।

হাইড্রোনেফ্রোসিস এর চিকিৎসায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ

গত ২৭/২/২০২৪ তালিকা আমি একটি চার দিন বয়সী বাচ্চা চিকিৎসা জন্য আহুত হয়েছিলাম। আমাকে ফোনে জানানো হয়েছিল মাত্র ৪ দিন বয়সী ছোট বাচ্চা প্রস্রাবের পূর্বে ভীষণ কান্না করে। হাত-পা গুটে সটি হয়ে যায় শরীর কাঁপতে থাকে তারপর প্রস্রাব হয়ে গেলে তখন বাচ্চাটি কান্না থামায়। জন্মের পর থেকে বাচ্চাটি প্রস্রাব করার পূর্বে এভাবে কাঁদে।

বাচ্চাটির হাইড্রোনেফ্রোসিস রিপোর্ট

আমি বাচ্চাটিকে দেখতে গেলাম। গিয়ে বাচ্চার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখলাম। রিপোর্টে হাইড্রোনেফ্রোসিস উল্লেখ করা আছে। বাম পাশের কিডনিতে সমস্যার উল্লেখ আছে। এমনকি বাচ্চাটি আমার সামনেই একবার ভয়ানক কান্না করে তারপর প্রস্রাব করল।

আমি সাথে করে এপিস মেল ঔষধ টি নিয়ে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিতে 0/1 ঔষধটি আমার কাছে ছিল। 

খাওয়ার নিয়ম হিসেবে বলেছিলাম এক কাপ জলের ভেতরে এক ফোটা ঔষধ দিয়ে তাতে আঙ্গুল ভিজিয়ে ওই আঙ্গুলটি বাচ্চার গালে দিতে হবে। দিনে দুইবার সকালে এবং রাত্রে। (ব্রেস্ট ফিডিং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমি সাধারণত বাচ্চার মাকেই ঔষধ দিয়ে থাকি। কিন্তু এখানে বাচ্চার মা সিজারের কারণে অনেকগুলো ঔষধ খাচ্ছে বলে একটু দ্বিধাদন্ধে ছিল। এই অবস্থা বুঝতে পেরে আমি বললাম ঠিক আছে বাচ্চাই খাবে ঔষধ। তবে বাচ্চাকে যখন কেউ ঔষধ খাওয়াবে তখন ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নেবে)

পরে সংবাদ পেয়েছিলাম ঔষধটির মাত্র দুইটি ডোজ খাওয়ার পর থেকেই বাচ্চার কান্না বন্ধ হয়েছে আর একবারের জন্য কান্না করেনি। 

এই রোগীর এক সপ্তাহ পরে আবার আলট্রাসনোগ্রাম করার কথা বলে দিয়েছিলেন পূর্বের চিকিৎসক।

যাইহোক ঈশ্বরের অশেষ কৃপায়, হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কল্যাণে রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হলো।

এই লেখাটি ইংরেজীতে পড়ুনঃ
Hydronephrosis treatment in homeopathy

আরো পড়ুনঃ
লিভার সিরোসিস এর কারণ, লক্ষণ, চিকিতসা ও হোমিওপ্যাথি

ডাঃ দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
০২.০৩.২০২৪

——————————–

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগের নীতিমালা মেনে তবেই মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। প্রত্যেকটি মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে যাচাই করা হয়।

comment url